বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী সংগঠনসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্য থেকে আইন করে হরতাল নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। এ দাবির পেছনে জনসমর্থনও লক্ষ্য করা গেছে। তা সত্ত্বেও আমরা হরতাল বন্ধ করার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কথা বলেছি, লিখেছি। এখনও মনে করি যে, হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার, যা আইন করে কেড়ে নেওয়া যায় না। কিন্তু আজ হরতালের নামে যা হচ্ছে তা কি আদৌ সমর্থনযোগ্য?
হরতাল দেশের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে অগণিত হরতাল-বন্ধ-সাধারণ ধর্মঘট হয়েছে। হরতালের সময় পিকেটিং করা রেওয়াজ। কেউ দোকান খুললে বা গাড়ি বের করলে অনুরোধ করে বন্ধ করার চেষ্টা হয়। জোরাজুরি হয় না, তা নয়। কিন্তু অতি সম্প্রতি যা হচ্ছে, সেটি রীতিমতো তাণ্ডব। যাত্রীবাহী বাসে হামলা চালানো হচ্ছে, আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ককটেল-বোমা ছোড়া হচ্ছে। দগ্ধ হয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটছে। ১৮ মার্চ হরতালকারীদের হামলার শিকার হয়ে ফেনীতে একজন ট্রাকচালক মারা গেছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন ১৮ বছরের তরুণ সোহেল। এ তরুণ শ্রমিক সোমবার কাভার্ড ভ্যান থেকে পণ্য নামাচ্ছিলেন, এমন সময় হরতালকারীরা ভ্যানটিতে আগুন দিলে তিনি দগ্ধ হন। কেবল হরতালের দিন নয়, হরতালের আগের দিন ১৭ মার্চ দুপুরেই রাজধানীর ফার্মগেটে বাসে আগুন দেওয়া হয়। ওই রাতে তিনজন চিকিৎসক প্রাইভেট কারে হাতিরঝিলের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তারা বোমার আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর।
হরতালের আগের দিন গাড়ি চলাচলে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। তবে কেন হামলা হলো? হামলা হয়েছে আতঙ্ক তৈরির জন্য, যাতে হরতালের দিন আর কেউ গাড়ি নিয়ে বের না হয়। এ জন্য হরতালকারী দলের নেতাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনাবোধও কাজ করে না। ভাবখানা এমন যে, হরতালের মতো \’মহান কর্তব্য\’ পালনে কিছু লোকের প্রাণহানি ঘটতেই পারে। বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে এক জনসভায় অতি সহজেই আরও প্রাণহানির ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, রাজনৈতিক দলগুলোর হরতাল ডাকার অধিকার আছে। জনগণের তা পালন করা বা না করারও অধিকার আছে। জোর করে হরতাল পালনে বাধ্য করার এখতিয়ার কারও নেই। আর হরতালের আগে-পরে যানবাহনে বোমা হামলা, আগুন লাগিয়ে দেওয়া ফৌজদারি অপরাধ।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের এ দাবির বিষয়টি যৌক্তিক বলে মনে করি। এ দাবির প্রতি কেবল বিএনপি ও তার সহযোগীদের নয়, এর বাইরেও মানুষের সমর্থন রয়েছে। মহাজোট সরকারের শরিক দলের নেতারাও বিভিন্ন সময় এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তবে এ যৌক্তিক দাবিটি নিয়ে বিরোধী জোট যেভাবে আন্দোলনের নামে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করছে, তা সমর্থন করা যায় না।
সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। তবে সংসদের বাইরেও রাজপথে আন্দোলন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আন্দোলনের ধরন হবে যুগপৎভাবে_ সংসদের ভেতরে ও বাইরে। কিন্তু সংসদ বর্জন করে কেবল রাজপথের আন্দোলন গণতান্ত্রিক আবহের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
এ ব্যাপারে বিরোধী দলের কথা হচ্ছে, সংসদ বর্জনের ধারা আওয়ামী লীগই তৈরি করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি কি আওয়ামী লীগের ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে, ভুল থেকে কি শিক্ষা নেওয়া হবে না? আর তা-ই যদি হয়, তবে ভুলের মধ্যেই আমাদের হাবুডুবু খেতে হবে, কখনও সঠিক পথ তৈরি হবে না।
সংসদে যাওয়ার বিষয়টি জনস্বার্থ ও নৈতিকতা সম্পৃক্ত ব্যাপার। জনগণ ভোট দিয়েছেন সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য, সংসদ বর্জনের জন্য নয়। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে \’ওয়াকআউট\’ করা যেতে পারে, লাগাতার সংসদ বর্জন নয়।
সংসদ সদস্য হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করবেন, কিন্তু সংসদে যাবেন না, আইন প্রণয়নে নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখবেন না, তা কি সমর্থনযোগ্য? এ রেওয়াজ চলতে থাকলে গণতন্ত্রের চর্চা ও বিকাশ কী করে হবে?
ইতিপূর্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির রোডমার্চসহ জেলায় জেলায় সমাবেশে ব্যাপক জনসমর্থন লক্ষ্য করা গেছে। যা সরকারের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছিল; কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভ্রান্ত পদক্ষেপের কারণে বিএনপি ও তার শরিকরা জনসমর্থন হারাচ্ছে। কারণ, জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে পথচলা এবং তাদের সৃষ্ট সহিংস ধারায় অগ্রসর হওয়া। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভণ্ডুল করার জন্য হরতাল, বাসে আগুন, ট্রেনের স্লিপার তুলে ফেলা, বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগুন দেওয়া, জাতীয় পতাকা পোড়ানো, শহীদ মিনার ভাঙা এবং সর্বশেষ সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর-মন্দিরে আগুন দেওয়া ও ধ্বংস করার মতো সহিংস তাণ্ডব সৃষ্টি করেছে জামায়াত। এটি এই মৌলবাদী গোষ্ঠীর একাত্তরের ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিরোধী দলের নেতা সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে এসে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবের নিন্দা না করে পুলিশের ভূমিকাকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন। তিনি হতাহতের ঘটনাকে গণহত্যা বলে আখ্যায়িতও করেছেন। এটি সত্য যে, বিভিন্ন ধর্মীয় দল ও জামায়াত সৃষ্ট সহিংসতা মোকাবেলায় পুলিশের গুলিতে জামায়াত-শিবির-ধর্মীয় দলগুলোর কর্মীসহ সাধারণ মানুষ হতাহত হয়েছে। পাঁচজন পুলিশসহ জামায়াতের হাতে আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের কর্মী নিহত হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৭৪ জনের মৃত্যু। এটি বোধগম্য যে, পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশের ভূমিকার বিকল্প ছিল না। তবে পুলিশ পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করলে ও দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করলে এত মানুষের প্রাণহানি হতো না। তাই বলে কি একে \’গণহত্যা\’ বলা যায়? গণহত্যা বা জেনোসাইড হচ্ছে কোনো জাতিসত্তা বা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার নির্বিচার ও ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পিত কর্মকাণ্ড। কোনো দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সংঘটিত কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা বা জেনোসাইড বলা যায় না। তবে পুলিশের অদক্ষতা বা বাড়াবাড়ি সমালোচনাযোগ্যই নয়, অনিয়ম হলে তদন্তসাপেক্ষে এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া উচিত। কিন্তু খালেদা জিয়া তা না বলে গণহত্যা উল্লেখ করে জামায়াতের সহিংস-বর্বরতাকেই সমর্থন করেছেন। শুধু তা-ই নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং যুদ্ধাপরাধী-সন্ত্রাসী জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের \’নাস্তিক ও নষ্ট প্রজন্ম\’ বলে কটাক্ষ করেছেন। গণজাগরণ মঞ্চকে \’মঞ্চ-ফঞ্চ\’ বলে তা বন্ধ করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এসব কথাবার্তা জামায়াত-শিবিরপ্রীতির পরিচায়ক। এরপর জামায়াতের সহিংসতা বিএনপির কর্মীদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে।
১৮ দলের আন্দোলনের বিপজ্জনক প্রবণতা হচ্ছে, জামায়াত এই আন্দোলনকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভণ্ডুলের জন্য ব্যবহার করতে চাইছে এবং সমগ্র আন্দোলন সে পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করছে। বলা বাহুল্য, এ আন্দোলনে সহিংসতা যত বাড়বে, ততই আন্দোলন বিপথগামী হবে। এটি বিএনপির জন্যই শুধু নয়, দেশের রাজনীতির জন্য একটি অশুভ সংকেত।
এ ব্যাপারে আন্দোলনকারী বিরোধী দলকে যেমনি সচেতন হতে হবে, সরকারকেও সতর্ক থাকতে হবে। ক্ষমতাসীন জোটকে মনে রাখতে হবে, দেশের জনগণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ। এ বিচার সম্পন্ন করার জন্য বর্তমান সরকারের প্রতি জনসমর্থন রয়েছে। এর মানে এই নয় যে, জনগণ নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়টি বিবেচনা করবে না। বাস্তব সত্য হচ্ছে, বিপুলসংখ্যক মানুষ নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থার ব্যাপারেও ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করছে।
একটি ইস্যুকে সামনে এনে অন্য ইস্যুটি চাপা দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই সরকারের কর্তব্য হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুটি সম্পন্ন করার পাশাপাশি নির্বাচন চলাকালীন সরকারের রূপরেখার ব্যাপারে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ শুরু করা। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার কলাকৌশল ছেড়ে নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়ই অধিক।
সরকার একতরফাভাবে আদালতের রায়ের ভুল ব্যাখ্যা করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান বাতিল করে যে সংকটের জন্ম দিয়েছে, তা উত্তরণে তাদেরই অগ্রণী হতে হবে। কিন্তু সরকারের আচরণে কি তার প্রতিফলন দেখছি? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের যে প্রস্তাব রেখেছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৮ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় খালেদা জিয়াকে পাল্টা আক্রমণ করে দুই দলের মধ্যকার দূরত্ব আরও বাড়িয়েছেন। সরকারপ্রধানের মুখ থেকে বিরোধী দলের নেত্রীকে \’রক্তপিপাসু\’ কিংবা বিরোধীদলীয় নেতার \’মানসিক সুস্থতা\’ নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিষয়টি সমর্থনযোগ্য নয়।
পরিশেষে বলব, যুদ্ধাপরাধী ব্যক্তি ও দলের বিচার যখন চলছে, তখন জাতীয় মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতেই বিএনপিকে জামায়াতের হাত ছাড়তে হবে। অন্যদিকে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার প্রশ্নেও সরকারকে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপে বসতে হবে। এ ব্যাপারে কালক্ষেপণ কাম্য নয়।