violenceদেশজুড়ে চলছে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব। একের পর এক হরতাল, ঝটিকা হামলার মধ্য দিয়ে জননিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। একাত্তরের নৃশংস ও ভয়ঙ্কর চেহারায় হাজির হয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী ও তার অঙ্গ সংগঠন শিবির। কখনও স্বনামে, কখনও অন্যান্য সংগঠনের আড়ালে তারা সুপরিকল্পিত হামলা সংঘটিত করছে।
একাত্তরে ছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের সহিংসতা-বর্বরতা আর এখন টার্গেট বাংলাদেশ। ওরা বাংলাদেশের পতাকা পুড়িয়েছে, জাতির চেতনার স্মারক শহীদ মিনার ও মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দিয়েছে। একাত্তরের মতো সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর-মন্দিরে হামলা করছে। গত এক সপ্তাহে চট্টগ্রামের বাঁশখালী, বরিশালের গৌরনদী, নেত্রকোনার পূর্বধলা, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরের রায়পুর, কুমিল্লা, গাজীপুরসহ ১৪টি জেলার বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাট করা হয়েছে।
এই ফ্যাসিবাদী শক্তির তাণ্ডব ও সহিংসতায় সমগ্র জনগোষ্ঠী আতঙ্কিত। বাস-ট্যাক্সি-ভ্যান-ট্রেনের বগিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে তারা। বিভিন্ন স্থানে রেললাইন উপড়ে ফেলেছে, বেইলি ব্রিজের পাটাতন খুলে নিয়েছে। রাস্তা কেটে ফেলেছে। তারা গৃহের মধ্যে মানুষ আটকে আগুন দিয়েছে। যাদের ওপর আক্রোশ ছিল, তাদেরই টার্গেট করা হচ্ছে। ২ মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ এলাকায় পর্যটনের মোটেলে আগুন দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, সেখানে একজন প্রকৌশলীকে তিনতলা থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রের আবাসিক ভবনে ৪৮টি পরিবারের সদস্যদের আটকে রেখেই আগুন দেয় জামায়াত-শিবিরকর্মীরা।
বরাবরই তাদের টার্গেট পুলিশ বাহিনী। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে ৩ জনসহ ৬ পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ সবকিছুই প্রমাণ করে যে, তারা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে।
পুলিশ বাহিনী-র‌্যাব-বিজিবির সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গুলি, টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করেছেন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ মার্চ জামায়াতের সহিংসতা ও পুলিশের গুলিতে ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে_ এর মধ্যে জামায়াত-শিবিরের কর্মী ও পুলিশ সদস্য ছাড়াও ৩০ জন সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক কর্মী রয়েছেন। (তথ্যসূত্র :প্রথম আলো, ৫ মার্চ ২০১৩)।
জামায়াতি এই সহিংসতা মোকাবেলায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বাত্মক প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার জো নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রশাসন ও পুলিশ সদস্যরা কি যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে? এ ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বপ্রস্তুতি ও পরিকল্পনা নিয়েও কথা উঠেছে।
জানা কথা যে, দলের নেতাদের যুদ্ধাপরাধ মামলায় শাস্তি ঘোষণার পর জামায়াত বেপরোয়া হয়ে উঠবে, মরণ কামড় দেবে। তাই সঙ্গতভাবেই জামায়াত প্রভাবিত অঞ্চল ও ক্যাডারদের ওপর বিশেষ নজর রাখা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। সরকারের বিবেচনায় আনা উচিত ছিল, জামায়াতের পক্ষ থেকে যে কোনো ধরনের হামলা আসতে পারে। এসব কিছু বিবেচনা করে পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পদক্ষেপ নিলে সহজেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো।
মনে রাখতে হবে, জামায়াতের তাণ্ডবের ক্ষমতা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। তারা আরও হামলা ও রক্তপাত ঘটাতে পারে। তাই প্রশাসনের কাজ হবে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুত হওয়া। তবে কেবল পুলিশ প্রশাসন দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিরোধের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
জামায়াত-শিবির প্রতিরোধে নতুন প্রজন্মের জাগরণ ইতিবাচক অবদান রাখছে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে মোকাবেলার জন্য রাজনৈতিক প্রতিরোধ দরকার। সে উদ্যোগ কই? আমরা দেখছি, আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েই দায়িত্ব সারা হচ্ছে। এর বাইরে বাম দলগুলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে সোচ্চার হলেও তাদের কর্মতৎপরতা সীমিত। তাই সর্বাগ্রে সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধাপরাধের বিচারের আগে সব দলের মতামত নিয়ে তাদের সম্পৃক্ত করে এগোনো প্রয়োজন ছিল। সেক্ষেত্রে বিএনপি হয়তো সহযোগিতার হাত বাড়াত না, বিরোধিতাও করত না। যেমন এখনও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না তা বলছে না। ১৪ দল ও সব বাম দল এক কাতারে এসে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হতো। এখনও সে সুযোগ আছে। কিন্তু সরকারের ভাবখানা এমন যে, একাই যুদ্ধে জিতবে, কাউকে কৃতিত্বের ভাগীদার করবে না।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ক্ষমতাসীন দলও মাঠে নেই। সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা হচ্ছে, মন্দির পুড়ছে, ধ্বংসাত্মক কাজ হচ্ছে; জনগণকে নিয়ে এসব প্রতিরোধ করা কি তাদের কাজ নয়? এমন প্রতিরোধের খবর শুনছি না।
এর কারণ হতে পারে_ দলের নেতাদের ধারণা ছিল না যে, সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় হতে পারে। তারা ধরেই নিয়েছিল, এটি প্রতীকী বিচার হবে_ সাপও মরবে না, লাঠিও ভাঙবে না। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক সাজা হবে না, কেউ আক্রান্তও হবে না।
গত ৪২ বছর ধরে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জামায়াতকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। এটি সত্য, আশ্রয়-প্রশ্রয়ের ক্ষেত্রে বিএনপি এগিয়ে আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এ দায় এড়াতে পারবে না। এই প্রক্রিয়ায় জামায়াতের সঙ্গে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সখ্য গড়ে উঠেছে। ফলে একাত্তরে তাদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা ছিল, তা খানিকটা মিলিয়ে গেছে। মোকাবেলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে রাজনৈতিক দলগুলো। এটি সত্য যে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে রাজাকারদের প্রবেশ ঘটেনি। কিন্তু তৃণমূলে রাজাকার ও তাদের সন্তানদের সমাবেশ ঘটেছে। রাজাকারের সন্তানদের দলে নেওয়ায় কোনো আপত্তি নেই, তবে তারা কোন ভাবাদর্শে বিশ্বাসী সেটি বিবেচ্য।
প্রশ্ন হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটির নেতাকর্মীরা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করছে? বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে ধর্মের অনুশাসনের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। নির্বাচনে জামায়াতের কায়দায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ধর্মের ব্যবহার করেছে। জামায়াতের \’লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, দাঁড়িপাল্লা\’ স্লোগানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিএনপি \’ধানের শীষে বিসমিল্লাহ\’ এবং আওয়ামী লীগ \’নৌকার মালিক তুমি আল্লাহ\’ বলেছে। এখনও সভা-সেমিনারে তারা যা বলেন তাতে মনে হবে যে, তারাই ধর্মরাষ্ট্রের প্রবক্তা। শুনেছি যে, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জে \’রাজীব ও অন্য ব্লগারদের নাস্তিকতা\’র বিরুদ্ধে ইসলামী সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে বানিয়াচংয়ের সরকার দলীয় এমপিও ছিলেন। ভোটব্যাংকের হিসাব কষে আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতা নীতিকে ঊধর্ে্ব তুলে ধরছে না।
বলা বাহুল্য, আদর্শিক চেতনা ছাড়া কি জামায়াতকে মোকাবেলা করা সম্ভব? কেউ কেউ বলছেন, ধর্মের নামে রাজনীতি নয়, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলেই যথেষ্ট। আসলে জামায়াত এবং তার রাজনীতি দুই-ই শান্তি ও প্রগতির পথে হুমকি। তাই জামায়াত ও তার রাজনীতি দুটিকেই মোকাবেলা করা দরকার। তবে জামায়াত ও ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করাই শেষ কথা নয়, একাত্তরের পরিত্যক্ত এই ভাবাদর্শকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে লেখক, বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যম ও সংস্কৃতিকর্মীদের এগিয়ে আসতে হবে। ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। এটি তুলে ধরতে হবে_ ধর্ম মানুষের বিশ্বাস, তা রাজনীতির হাতিয়ার হতে পারে না, ধর্মের নামে সহিংসতা চলতে পারে না।
আশার কথা, জামায়াতি তাণ্ডব-সহিংসতার বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধ গড়ে উঠছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের যুবকরা সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, মন্দির পাহারা দিচ্ছে, কানসাটসহ শিবগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা প্রতিরোধে সর্বদলীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি প্রশংসনীয়। একাত্তরেও জনগণ সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। আজও দরকার এই অপশক্তির বিরুদ্ধে একাত্তরের চেতনায় উজ্জীবিত গণপ্রতিরোধ।
আজ ধর্মের নামে যে বিভাজনের চেষ্টা চলছে, চাঁদে সাঈদীকে দেখা গেছে বলে যে কুসংস্কার ছড়ানো হচ্ছে, ধর্মান্ধতাকে উস্কে দেওয়া হচ্ছে_ তা মোকাবেলার জন্য অসাম্প্রদায়িক-মানবিক চেতনারও প্রসার ঘটাতে হবে। জামায়াতের খোলস উন্মোচন করে মানুষের কাছে তাদের প্রকৃত চেহারা তুলে ধরতে হবে।
একাত্তরে এই অপশক্তি ধর্মের নামে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল। কিন্তু জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি। ৪২ বছর পর ওই পুরনো খেলা চলবে না, চলতে পারে না। তবে ক্ষেত্রবিশেষে অনাসৃষ্টি ঘটতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন সুপরিকল্পিত, সতর্কিত ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ, যা সরকারকে গ্রহণ করতে হবে।