1মৃত্যুমাত্রই বেদনাদায়ক। অচেনা-অজানা মানুষের মৃত্যুর সংবাদও আমাদের ব্যথিত করে। আর যখন সেই মৃত্যু হয় সংঘর্ষে, বুলেটের আঘাতে, তখন আরও বেদনাবিহ্বল হতে হয়। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে হরতালের সমর্থক ও গ্রামবাসীর সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে চার ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। এ মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত। এ সংবাদ শোনার পর থেকে আমার চোখে ভাসছে সন্তানহারা মায়ের আহাজারি, স্বামীহারা জায়ার বুকফাটা আর্তনাদ, পিতৃহারা শিশুদের হৃদয়ভেদী চিৎকার। ওরা কোন সংগঠনের সমর্থক তা বিবেচ্য নয়, বিবেচনার বিষয়_ ওরা অকালে ঝরে গেল।
এর আগে ১৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগের জাগরণ মঞ্চের কর্মী মেধাবী প্রকৌশলী রাজীবের প্রাণ ঝরে গেছে আততায়ীর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে। সে শোকে সবাই যখন বিহ্বল, তখন নতুন এক পরিস্থিতি তৈরি হলো। নিহত রাজীবের বিরুদ্ধে শুরু হলো চিহ্নিত মহলের কুৎসা, অপপ্রচার, বিক্ষোভ ও হরতাল। এই বিক্ষোভ ও হরতালে বেশ কয়েকটি মৃত্যু ঘটেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। ২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ইসলামী দলগুলোর বিক্ষোভে সিলেট, ঝিনাইদহ, গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে চারজন এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার পাবনায় দুই বিক্ষোভকারী, টাঙ্গাইলে অগি্নদগ্ধ হয়ে এক শিক্ষার্থী মারা যান। এ ছাড়াও প্রজন্ম \’৭১ চত্বরে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্য বাদল মিয়াকে ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে ডিউটিরত অবস্থা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। রহস্যজনকভাবে প্রাণ হারিয়েছেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর যুদ্ধাপরাধ মামলার সাক্ষী ওয়াহিদুল ইসলাম জুনু। এ মৃত্যুগুলোর দায় কার?
শাহবাগ জাগরণের কর্মী ব্লগার রাজীব হায়দার নিহত হওয়ার পর কতিপয় সংবাদপত্রে রাজীব হায়দারকে নাস্তিক ও ধর্ম অবমাননাকারী আখ্যা দেওয়ার পর দেশজুড়ে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। ইসলামী দলগুলোর পক্ষ থেকে বিক্ষোভ ও হরতালের মতো কর্মসূচি দেওয়া হয়। সে বিক্ষোভ ও হরতালে অংশ নিয়ে অনেকেই নিহত হয়েছেন। ওদেরকে বলা হয়েছিল ব্লগার রাজীবের কথা। বলা হয়েছিল, ওই রাজীব খুবই বিপজ্জনক। এমনকি তার মৃত্যুর পরও ইসলামের ভয়ানক ক্ষতি করতে পারে_ এমন কিছু ব্লগে লিখে রেখে গেছেন। মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও ধর্মপ্রাণ মানুষকে এভাবেই উস্কে দেওয়া হয়েছে। আর যারা উস্কে দিয়েছেন, তারা এসব বয়ান দিয়েই নিরাপদে অবস্থান করছেন। তাদের সন্তান ও স্বজনরা মিছিলে যাননি, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। সাধারণ মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট উস্কে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার কৌশল আমরা পাকিস্তানের ২৪ বছরজুড়ে দেখেছি। একাত্তরে তারা ইসলাম ও পাকিস্তান রক্ষার নামে একইভাবে ধর্মকে ব্যবহার করেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও একইভাবে ধর্ম রক্ষার নামে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে, অনেক নিরীহ ও ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। কারও না বোঝার কথা নয় যে, এর নেপথ্যে রয়েছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী। যুদ্ধাপরাধীর বিচার ভণ্ডুল করতে কৌশলে তারা এই খেলা খেলছে। প্রকাশ্যে রয়েছে সমমনা ইসলামী কতিপয় দল_ তারা জামায়াতবিরোধী হলেও জামায়াতের পরিকল্পনা অনুযায়ী মাঠে নেমেছে। এটি যে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা, তা সাদা চোখেই বোঝা যায়।
ব্লগে যারা ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তবুদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে চর্চা করেন_ সেই অগ্রসর চিন্তার তরুণরাই যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার গুরু অপরাধে লঘুদণ্ড (যাবজ্জীবন কারাদণ্ড) হওয়ায় শাহবাগের সামনে অবস্থান শুরু করে। এর মধ্য দিয়ে যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়, তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দিশারি। এ আন্দোলন কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে নয়, বরং ধর্মের নামে যারা একাত্তরে গণহত্যা করেছে তাদের বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মের জাগরণ। সেই জাগরণের কর্মীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা থাকতে পারে, তা ভেবে দেখার বিষয়।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। বিভিন্ন সূত্রে অবহিত হয়েছি যে, রাজীবের নামে এক বছর আগে খোলা একটি ওয়ার্ডপ্রেস আইডি, যা দীর্ঘদিন অকার্যকর ছিল, ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে সেটি চালু করে সেখানে মহানবীর (সা.) নামে কটূক্তিপূর্ণ কিছু লেখা সনি্নবেশিত করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাজীব যদি এক বছর আগেই নবীর (সা.) প্রতি কটাক্ষপূর্ণ উক্তি করে থাকে, তবে তখন তার প্রতিবাদ হলো না কেন? তাকে হত্যা এবং যুগপৎ তার বিরুদ্ধে কাফের ও মুরতাদের অভিযোগ আনার পেছনে কোনো যোগসূত্র আছে কি-না, সেটি খতিয়ে দেখার বিষয়।
উল্লেখ্য, ব্লগের লেখার বিরুদ্ধে ব্লগেই বিতর্ক হয়। কিন্তু হঠাৎ করে তা কতিপয় সংবাদপত্রে কেন স্থান পেল? কেবল স্থানই পেল না, বড় বড় হেডলাইন করে নবীর (সা.) অবমাননাসহ বিভিন্ন উস্কানিমূলক যেসব কথা এসব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে_ তা কোনোক্রমেই সংবাদপত্রের নীতিমালার মধ্যে পড়ে না। এসব কিছুই রীতিমতো ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টির ঘৃণ্য প্রয়াস। যদি যুক্তির খাতিরে ধরে নিই, রাজীবের ব্লগে ধর্ম সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য ছিল। কিন্তু সেসব বয়ান করে কোনো জাতীয় সংবাদপত্রে এমনভাবে ব্যানার হেড করে তা কি প্রকাশ করা যায়? এটি দায়িত্বশীলতার পরিচায়ক নয়। প্রশ্ন এসে যায়, এসব কিছুই কি একই ষড়যন্ত্রের সুতায় গাঁথা কি-না!
যাদের তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা রয়েছে তারা জানেন, যে কোনো ব্যক্তির নামে ফেক আইডি খোলা যায়। নায়ক-নায়িকাদের নামে ফেসবুকে অনেক আইডি রয়েছে, যা তাদের খোলা নয়। ফেসবুকে বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে নতুন নতুন আইডি দেখেছি। সেগুলো কি তার? শুনেছি, এর মধ্যে কোনোটিই তার নয়। একজনের নামে আইডি খুলে কিংবা কোনো আইডিতে আপত্তিকর তথ্য ও ছবি দিয়ে বিব্রত ও বিপাকে ফেলার ঘটনা অহরহ ঘটছে। রামুর ঘটনাটিও ছিল এমনই। সে ঘটনায় জনৈক বৌদ্ধ তরুণকে একটি ছবিতে ট্যাগ করে সহিংসতা ছড়ানোর জন্য অপপ্রচারে নেমেছিল এবং ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছিল ধর্মান্ধরা। আর আজ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে, সেই রাজীবের বক্তব্য শোনার সুযোগ নেই। কেননা তিনি মৃত।
এখন ইসলামী দলগুলোর নেতারা এমনভাবে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন যে তাতে মনে হবে ব্লগার মানেই কাফের-মুরতাদ। তারা কি জানেন যে, দেশে প্রায় তিন লাখ ব্লগার রয়েছে। তার মধ্যে ধর্মকর্ম করা লোকের সংখ্যা কম নয়। সোনার বাংলা জামায়াতের একটি ব্লগসাইটও রয়েছে (যা সম্প্রতি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে)।
ধরে নিই, ব্লগে যারা লেখালেখি করছেন তার মধ্যে দু\’চারজন নাস্তিক আছেন। সে জন্য সব ব্লগার মুরতাদ হয়ে যাবে? তরুণদের মধ্যে কিছু নাস্তিক আছেন বলে তরুণরা অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যাবে? এ ধরনের অযৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামও সমর্থন করে না। ধর্মের নামে প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধাচরণ নতুন ঘটনা নয়। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, মুসলিম জনগোষ্ঠী যেসব সৃষ্টিশীল মানুষকে নিয়ে গর্ব করে একসময় তাদের কি কম গঞ্জনা সইতে হয়েছে? মীর মশাররফ হোসেন, বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আবদুল ওদুদ, আহমদ শরীফ, সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখকে কাফের-মুরতাদ বলা হয়েছে। ধর্মান্ধদের কাছে চিকিৎসা বিজ্ঞানী-দার্শনিক ইবনে সিনা, কবি ওমর খৈয়ামও মুরতাদ ছিলেন। অতীতে ফুটবল খেলা ছিল শুয়োরের মাথা, রেডিও শয়তানের বাক্স, মাইক শয়তানের গলা, ইংরেজি শিক্ষা হারাম আর এখন ব্লগে মুক্তবুদ্ধির চর্চা নাস্তিকতা_ এ মনোভাবের পরিবর্তন ভিন্ন কি জাতীয় অগ্রগতি সম্ভব?
ধর্মান্ধতা-ধর্মব্যবসা যখন এক রেখায় মেলে, তা কী ক্ষতিকর হতে পারে তা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে জামায়াতও কৌশলে তাদের বিরুদ্ধাচরণকারী ইসলামী দলগুলোকে মাঠে নামিয়েছে এবং তারা সুযোগমতো ঝটিকা তাণ্ডব সংঘটিত করছে। একাত্তরের মতো ওরা শহীদ মিনারে হামলা চালিয়েছে, জাতীয় পতাকা ছিন্নভিন্ন করেছে। এটি জাতীয় মর্যাদা ও সংহতির প্রতি আঘাতের শামিল।
এ অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টির জন্য মাদ্রাসাছাত্র ও ধর্মপ্রাণ মানুষকে উস্কে দেওয়া হচ্ছে। যার পরিণতিতে সিঙ্গাইরসহ বিভিন্ন স্থানে হরতাল সমর্থক ও পথচারীরা প্রাণ হারিয়েছেন। এ দায় ষড়যন্ত্রের মধ্যমণি জামায়াত এবং হরতাল আহ্বানকারী ইসলামী দলগুলো এড়াতে পারে না। এড়াতে পারে না সেসব সংবাদপত্র, যারা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টিতে ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে। যে সাংবাদিকতা রাজীবের মতো তরুণের মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটন ও বিচারের দাবির প্রতি সমর্থন করে না, উপরন্তু মৃত ব্যক্তিকে কলঙ্কিত করে, হত্যাকারীকে আড়াল করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে, সেটি সৎ সাংবাদিকতা হতে পারে না।
আশার কথা, তরুণ প্রজন্ম \’জয় বাংলা\’ স্লোগান বুকে ধারণ করে জাতীয় পতাকা ঊধর্ে্ব তুলে ধরেছে। তারা বলছে, আমাদের সংগ্রাম ধর্মের বিরুদ্ধে নয়, বরং তাদের বিরুদ্ধে_ যারা ধর্মের অপব্যবহার করছে, ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করছে। শাহবাগ চত্বর ছাড়িয়ে সারাদেশের তারুণ্যের কণ্ঠে আজ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে_ \’রাষ্ট্র সবার, ধর্ম যার যার।\’ এ নীতিতেই প্রকৃত সমাধান, অন্য কোনো পথে নয়।