shahbagজেগে আছে শাহবাগ। সেখানে ১৬ দিন ধরে অবস্থান করছে নতুন প্রজন্মসহ নানা বয়সের হাজার হাজার নরনারী। সাম্প্রতিক সময়ের মিসরের \’তাহরির স্কয়ার\’ ও যুক্তরাষ্ট্রের \’অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট\’ আন্দোলনের সঙ্গে কেউ কেউ এর তুলনা করছেন। তবে শাহবাগের সঙ্গে তুলনীয় কেবল শাহবাগই। এ এক ভিন্ন মাত্রার অভূতপূর্ব ঘটনা।
বাংলাদেশে তারুণ্যের পরাকাষ্ঠতা দেখা গেছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, \’৪৮-৫২ ভাষা আন্দোলন, \’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, \’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও \’৯০-এর স্বৈরশাসন উৎখাতে। সেই তারুণ্য এখন বিস্ফোরিত নবচেতনায়, অনন্য দৃঢ়তায়।
যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে তার কৃত অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড না দেওয়ায় নতুন প্রজন্মের ব্লগারসহ সামাজিক গণমাধ্যমের কর্মীরা শাহবাগে অবস্থান গ্রহণ করে ৫ ফেব্রুয়ারি। তারপর থেকে শুরু হয় শাহবাগমুখী গণজোয়ার। এখন সমগ্র জাতিই সেই জোয়ারে উত্তাল। শাহবাগের নতুন প্রজন্ম জানিয়ে দিয়েছে যে, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা রাস্তা ছাড়বে না।
এখন কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডই তাদের কাছে শেষ কথা নয়। সংসদের স্পিকারের কাছে যে ছয়টি দাবি তারা তুলে ধরেছে, তা হচ্ছে কাদের মোল্লাসহ চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি (মৃত্যুদণ্ড), আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্তদের রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার বিধান রহিত করা, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ, অতীতে দণ্ডপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা, জামায়াতের আর্থিক প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করে সেসব অধিগ্রহণ করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তি ও দলেরও বিচার করা। জাতীয় সংসদে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন করে অভিযুক্তের পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষ ও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আপিলের সুযোগ অবারিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ব্যক্তির পাশাপাশি দলের বিচারের বিধানও সংযুক্ত হয়েছে। এটি আন্দোলনকারীদের প্রাথমিক বিজয়। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রশ্নে যে সংশয় ও সন্দেহ দেখা দিয়েছিল, তা দূর হয়েছে। নতুন প্রজন্মসহ জনগণ আশাবাদী যে, এখন আর হীন রাজনৈতিক স্বার্থে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি অনুকম্পা দেখানো হবে না। আর অপর গুরুত্বপূর্ণ দাবি হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে সরকার ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে। নিহত ব্লগার রাজীবের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এদের আর রাজনীতি করার অধিকার নেই। সরকারের এ মনোভাব থেকে ধারণা করা যায়, জামায়াত নিষিদ্ধ হতে পারে। সরকারের এমন পদক্ষেপ গণজাগরণের সাফল্য হিসেবেই বিবেচিত হবে, তাতে সন্দেহ নেই।
প্রসঙ্গক্রমে বলা আবশ্যক, স্বাধীনতার ৪২ বছর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ চলেনি। শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটেনি। ইতিপূর্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা এগোয়নি। উপরন্তু অতীতে একাত্তরের ঘৃণিত ও চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে কৌশলের নামে হাত ধরাধরি করে চলার যে রাজনীতি চলেছে জনগণ তা মেনে নিতে পারেনি। বিগত চারদলীয় জোটের মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ যখন গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে ছুটেছেন, তা একাত্তরের বিজয়ী জাতির মধ্যে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম যারা বাবা-মায়ের কাছে একাত্তরের গল্প শুনেছে, বই পড়েছে, সিনেমা-নাটকে যুদ্ধাপরাধীদের বর্বরতা দেখেছে_ সেই অপশক্তির দাপট তাদের আহত করেছে। তাই বিগত সাধারণ নির্বাচনের ইশতেহারে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার করলে নতুন প্রজন্ম আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছে, ভোট দিয়েছে। কিন্তু দায়সারা বা মুখ রক্ষার বিচার তাদের ক্ষুব্ধ করেছে। ব্লগে, ফেসবুকে তারা সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে। কিন্তু যথাসময়ে ভার্চুয়াল ওয়ালের লেখা পড়তে পারেনি মহাজোট সরকার। সবশেষে যখন যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার গুরু পাপে লঘুদণ্ড (যাবজ্জীবন কারাদণ্ড) দেওয়া হলো, তখনই এই তারুণ্যের বিস্ফোরণ ঘটেছে।
অনাকাঙ্ক্ষিত নতুন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব না হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের আন্দোলনের প্রথম ধাপ অতিক্রান্ত হতে পারে। তবে জাগরণের মধ্য দিয়ে যে চেতনার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে, তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
দেশে রাজনীতির নামে পালাক্রমে দুই দলের যে ক্ষমতাবাজি, দলবাজি, দুর্নীতি, অপশাসন চলেছে_ এই বুদ্ধিদীপ্ত তরুণরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। এ সচেতনতার কারণেই তারা প্রজন্ম মঞ্চকে রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত রেখেছে। ওই মঞ্চ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, এটি কোনো দলের নয়, এটি জনগণের জাগরণ।
নতুন প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধের বিচারের পথিকৃৎ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রতিকৃতি ঊধর্ে্ব তুলেছে, যিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দেশকে কলঙ্কমুক্ত করার আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন। সেই বীরমাতাকে সামনে নিয়েই প্রজন্ম একাত্তরের চেতনায় নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। যে স্বপ্ন একাত্তরে জনগণের চোখে ছিল, সেই স্বপ্ন এখন নতুন প্রজন্মের চোখে জ্বলছে। তাই আমার মনে হয়, এই জাগরণ যে ঢেউ তুলেছে, তা কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারই করবে না_ ৪২ বছরের জমে থাকা সব অন্যায়ের স্তূপ, আপসকামিতা, সুবিধাবাদিতাকে ভাসিয়ে নেবে। একাত্তরের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক সাম্যভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামকে বেগবান করবে।
দ্বিমতের সুযোগ নেই যে, একাত্তরের চেতনায় বাংলাদেশ গড়তে হলে আগে একাত্তরের কলঙ্ক মোচন করতে হবে। এ জন্য সব চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিও নিষিদ্ধ করতে হবে।
উল্লেখ্য, জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়া এবং জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া এক নয়। জামায়াতের রাজনীতি যদি নিষিদ্ধ না হয়, পাশাপাশি আদর্শিকভাবে তা মোকাবেলা করা না যায়, তবে জামায়াতের নেতাকর্মী-অনুসারীরা আবার ভিন্ন নামে আরেকটি দল দাঁড় করিয়ে সেই একই রাজনীতি করবে, যা হবে জামায়াতের রাজনীতিরই পুনরুত্থান। তাই যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং তা মোকাবেলার বিষয়টি ভাবা প্রয়োজন। কী সেই রাজনীতি? সেটি হচ্ছে পাকিস্তানি ভাবাদর্শ, ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। এসবের বিষময় ফল নিয়ে নতুন করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। তাই ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিযুক্ত করা হয়েছিল, ধর্মের নামে যাতে আর কেউ ধোঁকা না দিতে পারে, মানুষে মানুষে বিভাজনের দেয়াল তুলতে না পারে। সে কারণেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বিষয়টি ১৯৭২ সালের সংবিধানেই অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, \’জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধসাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে; তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা লক্ষ্যানুযায়ী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক কোনো সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাদের সদস্য হইবার বা অন্য কোনো প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোন ব্যক্তির থাকিবে না।\’ এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার যৌক্তিক প্রতিফলন।
১৯৭৫ সালের পর খন্দকার মোশতাক আহমদ ও জিয়াউর রহমানের হাত ধরে পাকিস্তানি ভাবাদর্শ অনুপ্রবেশ করে। জয় বাংলার পরিবর্তে পাকিস্তান জিন্দাবাদের আদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ও বাংলাদেশ বেতারের স্থলে রেডিও বাংলাদেশ ইত্যাদির পাশাপাশি পঞ্চম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রণীত সংবিধানকে বিকৃত করে ধর্মীয় ছাপ দেওয়া হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা নির্বাসিত করা হয় এবং একই সঙ্গে ৩৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দ্বার খুলে দেওয়া হয়। বলা বাহুল্য, যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের একাংশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া সাধারণ ক্ষমায় জীবন রক্ষা পেয়েছিল, জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণের পর দালাল আইন বাতিল হলে কারও বিরুদ্ধেই কোনো অভিযোগ রইল না। উপরন্তু সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর আওতায় তারা জামায়াতে ইসলামী পুনর্গঠনের সুযোগ লাভ করেন।
প্রাকৃতিক নিয়মে মুসলিম লীগ বিদায় হলেও জামায়াত মধ্যপ্রাচ্যের আর্থিক সহায়তায় ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন গড়ে তুলতে সমর্থ হয়। বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে জামায়াতের সঙ্গ পাওয়ার যে প্রতিযোগিতা করেছে, তা জামায়াতকে এক ধরনের বৈধতার ছাপ দিয়েছে।
জামায়াত এখন বিএনপির ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়েছে। তবে সেদিনও শোনা গেছে, পর্দার আড়ালে সরকার জামায়াতের সঙ্গে গোপন আঁতাতের চেষ্টা করছে। গণজাগরণের পর মহাজোট সরকার ওই পথে পা বাড়াবে না এমনটাই আশা করা যায়। কিন্তু জামায়াতের রক্ষাকবচ যে রাষ্ট্রধর্ম বিধান_ সরকার তা কি বাতিল করবে? \’৭২-এর সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ কি পুনর্স্ট্থাপন করবে?
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, আদালতের পঞ্চম সংশোধনীর রায়ের মধ্য দিয়ে \’৭২-এর সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল, মহাজোট সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে তা আবার সংশোধন করে জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে দ্বিতীয়বার রাজনীতি করার ছাড়পত্র দিয়েছে। স্বৈরাচারী এরশাদের সংযোজন রাষ্ট্রধর্মকেও রক্ষা করেছে। এ ভুল শুধরানোর এখনই সময়।
আজ তারুণ্যের জাগরণের প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যেতে হলে রাষ্ট্রধর্ম বিধান বাতিল ও \’৭২-এর সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপনের কোনো বিকল্প নেই।