shahbagযারা একাত্তর দেখেনি, সেই প্রজন্ম আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বেলিত। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে লঘু দণ্ড দেওয়ার প্রতিবাদে রাজধানীর শাহবাগে শুরু হওয়া তরুণ প্রজন্মের গণজোয়ার সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের ঠিকানা ছাড়িয়ে প্রবাসের বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীও একাত্ম হয়েছে এ জাগরণে। আট দিন ধরে চলা এ আন্দোলনে ক্রমেই বাড়ছে গণসম্পৃক্তি। এখন দেশের প্রতিটি মানুষকে স্পর্শ করেছে আন্দোলনের তাপ।
দেশের অগণিত শহীদ পরিবার ৪২ বছর ধরে স্বজন হারাবার যে বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছিল, মুক্তিযোদ্ধা-জনগণ ঘাতকদের বিচার না হওয়ার যে যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছিলেন_ সবাই আজ তরুণ প্রজন্মের ডাকে সাড়া দিয়ে আন্দোলনের তীর্থ শাহবাগে সমবেত হচ্ছেন। অনেকেই আসছেন সপরিবারে, সন্তান-সন্ততি, নাতিপুতি নিয়ে। গান, আবৃত্তি, নাটক, চলচ্চিত্র, বক্তৃতা, স্লোগান, চিত্র প্রদর্শনীতে মুখরিত হয়ে উঠছে শাহবাগ চত্বর। অনেকে বাড়ি থেকে তৈরি করা খাবার এনে তরুণ সংগ্রামীদের পরম মমতায় খাওয়াচ্ছেন। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। কেবল শারীরিক উপস্থিতি ও সহযোগিতাই নয়, একাত্তরের চেতনায় সকলে নিজেকে সজ্জিত করছেন।
যে অভিভাবকরা নতুন প্রজন্মের চিন্তা ও তৎপরতার ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান ছিলেন, ক্ষেত্রবিশেষে হতাশও ছিলেন, এখন তারাই এই তরুণদের মধ্যে নতুন আশার আলো দেখছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলে যাওয়ার বদলে এরাই যে একে শানিত করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, সে ভরসা তাদের ওপর রাখছেন। একাত্তরের প্রজন্ম ভাবছেন_ তরুণদের হাত ধরেই মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজ পূর্ণতা লাভ করবে।
এ আন্দোলন এখন কেবল কাদের মোল্লাসহ চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। জামায়াতে ইসলামীসহ যুদ্ধাপরাধী ও ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করা, তাদের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত করাসহ \’৭২-এর সংবিধানের মৌল চেতনায় প্রত্যাবর্তনের দাবিও উত্থাপিত হয়েছে। তবে দাবিনামার কেন্দ্রবিন্দুতে যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড। এটিই অযুত-লক্ষ কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছে।
প্রশ্ন হচ্ছে_ অতঃপর কী হবে? সরকারেরই-বা কী করণীয়? নীতি ও আইনগতভাবে সরকার আদালতের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সেটি সত্য, কিন্তু সুষ্ঠু বিচারের জন্য যা করণীয় তা কি সরকার যথাযথভাবে পালন করেছে? অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের শৈথিল্য দেখা গেছে। আরও দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ, তদন্ত বিভাগে লোকবল বাড়ানোসহ সহায়তা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষিত হয়েছে। সাক্ষীদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হয়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, সরকার যেন দায়সারা গোছের ও মুখরক্ষার বিচার করতে চাইছে। সরকারের আন্তরিকতা নিয়েও সন্দেহের যথেষ্ট কারণ থেকে যায়।
এ বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট আইনজীবী ও তদন্তকারীরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন। সব রকম হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে অনেক সাক্ষী হাজির হয়েছেন, ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। কাদের মোল্লাসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের ক্ষেত্রেও তা দেখা গেছে। কাদের মোল্লার যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে আদালতের রায়ে বিবৃত হয়েছে যে, ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে_ হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, গণহত্যা ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ২০-এর (২) ধারায় যখন মৃত্যুদণ্ড বা সমধর্মী অন্য শাস্তির উল্লেখ রয়েছে; সে ক্ষেত্রে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন এসে যায়, অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ড কেন দেওয়া হলো না?
কেউ কেউ আদালতের রায় উদ্ধৃত করে বলছেন, কাদের মোল্লা ওই সব অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে অন্যদের সঙ্গে ছিলেন, নেতৃত্ব দেননি। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনটি পূর্ণ পাঠ করে আমি নিশ্চিত হলাম, ওই ধরনের সাক্ষ্যের বিষয়টি এখানে প্রযোজ্য নয়। উপস্থিতি বা সংঘটিত করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টতাই যথেষ্ট। ৪(১) ধারায় রয়েছে, যখন ৩ ধারায় (হত্যা, ধর্ষণ, গণহত্যা ইত্যাদি) কতিপয় লোক অপরাধ সংঘটিত করেন, তখন সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকে এর জন্য এককভাবে অপরাধী হিসেবে দায়ী হবেন। যদি তাই হয়, তবে সেই ক্ষেত্রে আমি কেবল আলোকদি (আলুব্দি) গণহত্যার উল্লেখ করতে চাই। আদালত সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছেন যে, ওই হত্যাকাণ্ড যেখানে সংঘটিত হয়েছে, সেখানে একটি সংঘবদ্ধ দলের সঙ্গে কাদের মোল্লা জেনে-বুঝেই উপস্থিত ছিলেন এবং তার হাতে ছিল রাইফেল। কাদের মোল্লা, তার বিহারি সঙ্গী ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেখানে ৩৪৪ জন নারী-পুরুষ হত্যা করে। আইন অনুযায়ী বিবেচ্য যে, কাদের মোল্লা সংঘটিত অপরাধের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে সমভাবে দায়ী। অথচ এই ৩৪৪ জন মানুষের হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী হওয়ার পরও কাদের মোল্লার প্রতি অনুকম্পা দেখানো হয়েছে। ৬নং অভিযোগ অনুযায়ী, স্বাধীনতার সমর্থক হযরত আলী লস্কর ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ড এবং তার অপর কন্যার ধর্ষণের ঘটনায় কাদের মোল্লার উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে। এই দুটি মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের অপরাধ কি কোনো বিবেচনায় ছোট করে দেখা যায়?
রায় পড়ে মনে হয়েছে যে, এ ক্ষেত্রে ফৌজদারি মামলার দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করতে পারে। ফৌজদারি মামলায় মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ সাক্ষী দরকার পড়ে। সাক্ষী সরাসরি ভিকটিমকে আঘাত করেছে কি-না, সেই আঘাতের ধরন-ধারণ অনেক কিছুই বিবেচনায় আনা হয়। কিন্তু এই বিশেষ ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়ায় এটি বিবেচ্য নয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ অনুযায়ী আদালতের সাক্ষ্যগ্রহণের পরিধি অনেক বিস্তৃত। ১৯(১) ধারা অনুযায়ী আদালত \’টেকনিক্যাল রুলস অব এভিডেন্স\’ মানতে বাধ্য নয়। বরং সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, ফটোগ্রাফ, ফিল্ম, টেপরেকর্ডে ধারণকৃত বক্তব্য ইত্যাদি বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। যিনি বেঁচে নেই, ম্যাজিস্ট্রেট বা তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক পূর্বে রেকর্ড করা এমন ব্যক্তির বক্তব্যও সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার এখতিয়ার আদালতের রয়েছে।
আদালতে এসব দালিলিক প্রমাণও গ্রহণ করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়েছে যে, কাদের মোল্লা ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদুল্লাহ হল শাখার সভাপতি ছিলেন। এই সংগঠনের সদস্যরা আলবদর বাহিনীতে যোগ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে। এটিও তার অপরাধের সংশ্লিষ্টতার দালিলিক প্রমাণ।
এ প্রসঙ্গে ভারতের সদ্য মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আজমল গুরুর মামলার উল্লেখ করা যায়। ২০০১ সালে ভারতের পার্লামেন্টে হামলা মামলায় তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। তিনি হামলার ঘটনায় অংশ নেননি। তবে তার সংশ্লিষ্টতা ছিল। যোগসূত্রতা ছিল_ যেটি পারিপাশর্ি্বক অবস্থার বিবেচনায় (ঈরৎপঁসংঃধহঃরধষ) প্রমাণিত। কিন্তু অপরাধের গুরুত্ব অনুধাবন করে আজমল গুরুকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
এমন বহু উদাহরণ দেওয়া যাবে যেখানে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছাড়াও গুরুদণ্ড হয়েছে। অথচ এ ক্ষেত্রে গুরু অপরাধে লঘুদণ্ড হলো। কাদের মোল্লা মানবতাবিরোধী অপরাধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন, যা আদালতের কাছে প্রমাণিত।
গোলাম আযম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কাদের মোল্লা প্রমুখ এ জাতির অভ্যুদয় ও অস্তিত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। আর একাত্তরে জাতির অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে এরা শুধু যুদ্ধই করেননি, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ করেছেন। এ অপরাধ পর্বতপ্রমাণ। এ অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কিছু জাতির কাছে কাম্য নয়। এ ঘৃণ্য ও চিহ্নিত অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড না হওয়ার ঘটনা দেশবাসীকে বিক্ষুব্ধ করেছে।
ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করার সুযোগ এবং আপিল বিভাগের বিচার সম্পন্ন করার সময়সীমা নির্ধারণ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এটিই যথেষ্ট নয়। তদন্ত, প্রসিকিউশনের সব দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠাও জরুরি।
পরিশেষে বলতে হয়, জনগণ একাত্মতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ পরিচালনার যে আওয়াজ উঠেছে, গণজাগরণ মঞ্চ থেকে জামায়াতে ইসলামীসহ যুদ্ধাপরাধী ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের যে দাবি উঠেছে, গতকাল মঙ্গলবার দেশের সমস্ত মানুষ যে যার জায়গায় তিন মিনিট দাঁড়িয়ে মৌনতা পালনের মধ্য দিয়ে সেই দাবির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেছে।
সরকারের মন্ত্রী-সাংসদরা এসে গণদাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ দাবির সঙ্গে একমত হয়েছেন। এটি যদি সরকারের বিবেচনায় যৌক্তিক দাবি হয়, তবে তা এগিয়ে নিতে আইন সংশোধনের পাশাপাশি জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ ও তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্তসহ যৌক্তিক দাবি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়ায় কালক্ষেপণ কাম্য নয়। আর সেটি করার মধ্য দিয়ে একাত্তরের চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম একধাপ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব, সে স্বপ্ন আজ সমগ্র জাতি দেখছে।