ask site
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেসব বিতর্কের অবসান হয়েছিল, আজ নতুন করে তা শুনছি। বাংলাদেশ কেমন রাষ্ট্র হবে_ তা নিয়ে তখন কোনো বিতর্ক ছিল না। ১৯৭২-এর সংবিধানে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষতাও রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। আজ বিভিন্ন মহল থেকে কৌশলে \’মডারেট মুসলিম রাষ্ট্র\’ বা রাজনীতিতে ধর্মের সংমিশ্রণের কথা বলা হচ্ছে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পক্ষাবলম্বন করা হচ্ছে। এ-ও বলা হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা ইউরোপীয় ধারণা, বাংলাদেশে তা প্রযোজ্য নয়।
প্রসঙ্গক্রমে বলা আবশ্যক, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ইউরোপে বিকশিত হয়েছে। আমরা আমাদের প্রয়োজনে তা ধারণ করেছি। ধর্মনিরপেক্ষতাকে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকেই গ্রহণ করেছি। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান শাসনামল এবং তার আগে ব্রিটিশের ভেদনীতি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকেই জাতি নীতি হিসেবে বরণ করেছে ধর্মনিরপেক্ষতা।
এ কথা সত্য, ব্রিটিশ ভারতে বাংলার পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠী ব্রিটিশ বিতাড়নের পাশাপাশি জমিদারদের শোষণ, নিপীড়ন থেকে মুক্তি চেয়েছে এবং সে কারণেই পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থনও করেছে। কিন্তু \’৪৭-এর পরই তাদের উপলব্ধি ঘটেছে যে, পাকিস্তান হওয়ার মধ্য দিয়ে শাসক-শোষকের হাতবদল হয়েছে, তারা প্রকৃত অর্থে স্বাধীন নয়। \’৪৭-এর পর পরই শাসকগোষ্ঠী বোঝাতে চেয়েছে, তোমরা মুসলমান, তোমাদের ভাষা উর্দু। বাংলার ছাত্র-জনতা দিব্য চোখে দেখেছে যে, তাদের মাতৃভাষা কেড়ে নেওয়ার এ এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। তাই \’৪৮-৫২তে বাংলার ছাত্র-জনতা জ্বলে উঠেছে। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এক হয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত করেছে।
বাংলা ভাষার মধ্যেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার মন্ত্র আছে, তা ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি নতুন করে উপলব্ধি করেছে। বাংলা ভাষা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের মাতৃভাষা। সুদূর অতীত থেকে এ ভাষাতে মানবিকতার বাণী উজ্জীবিত হয়েছে। একদা বাংলা ভাষার লোককবি লিখেছেন, \’নানা বরণ গাভীরে ভাই/একই বরণ দুধ/জগত ঘরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত\’। সাম্প্রদায়িক সমন্বয়ের ধারার অনেক উপমা দেওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে কবি ভারতচন্দ্রকে উদ্ধৃত করতে চাই। তিনি ভবানন্দ মজুমদারের জবানিতে বলেছেন, \’হিন্দু-মুসলমান আদি জীবজন্তু যত।/ঈশ্বর সবার এক নহে দুই মত\\/পুরাণের মত ছাড়া কোরানে কি আছে।/ভাবিয়া দেখ, আগে হিন্দু। মুসলমান পাছে\\\’ চণ্ডীদাশ-ভারতচন্দ্র-লালন এ ভাষায় মানবিকতার বীজ বুনেছেন। আর মাইকেল-বিদ্যাসাগর_মীর মশাররফ-রবীন্দ্র-নজরুল-জসীম উদ্দীন_জীবনানন্দ-মানিক-সুকান্তরা তা পত্রপল্লবে শোভিত করেছেন। এটাই বাংলা ভাষার সৌন্দর্য এবং সর্বজনীন মানবিক রূপ। এই মানবিক বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে এই জনপদের মানুষ ভেদনীতি পরাস্ত করেছে। বাংলার মানুষ জেগে উঠেছে অসাম্প্রদায়িক চেতনায়।
এ কথা কারও অজানা নয় যে, পাকিস্তান শাসনামলে বিভেদ সৃষ্টির জন্য শাসকগোষ্ঠী বারবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়েছে। রুখেও দাঁড়িয়েছে হিন্দু-মুসলমান। জনতার প্রতিরোধের মুখে সে দাঙ্গা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদের দেয়াল তুলতে পারেনি। বরং সমন্বয়ের ধারাই বেগবান করেছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মুখে ধর্মীয় বুলি আর হাতে ছিল শোষণের নীলনকশা। সেই বুলি বাংলার জনগণ কখনও বিশ্বাস করেনি, উপরন্তু উপলব্ধি করেছে ধর্মরাষ্ট্রই সম্প্রীতির পথে বড় বাধা। যে কারণে বাংলার জনগণ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ও ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার থেকেছে। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ও তাদের সমর্থক জামায়াতে ইসলামী, নেজামী ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি যতই ধর্মীয় বিভাজনের চেষ্টা করেছে, জনগণ তা রুখে দাঁড়িয়েছে। ইসলামের দোহাই পেড়ে পাকিস্তান রক্ষার রাজনীতির পাশে জনগণ দাঁড়ায়নি। বরং এ দেশের মানুষ শের-এ-বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি বারংবার সমর্থন ব্যক্ত করেছে। সেই ধারাবাহিকতায়ই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ।
ধর্মনিরপেক্ষতার মর্মবাণী_ ধর্ম হবে ব্যক্তির, রাষ্ট্র হবে সবার। ধর্মীয় বিশ্বাসে কোনো ব্যক্তি টুপি পরতে পারে, টিকিও রাখতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের মাথায় টুপি থাকবে না, টিকিও থাকবে না। কোনো ধর্মকে বিশেষ মর্যাদাও দেওয়া যাবে না। একইভাবে কোনো জাতি বা লিঙ্গকেও বিশেষ মর্যাদা দেওয়া যাবে না। রাষ্ট্র হবে ধর্ম-জাতি-লিঙ্গ নিরপেক্ষ।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ব্রিটিশের \’ভাগ কর শাসন কর\’ নীতি, দেশ বিভাগ-দাঙ্গা সর্বোপরি ধর্মের নামে পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ থেকে জনগণ ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেছে। এটি ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোনো বিষয় নয়। কোনো দেশ থেকে আমদানি করাও নয়। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই প্রথম রাষ্ট্র, যা ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে ধারণ করে। ১৯৭২ সালেই বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। চার বছর পর ১৯৭৬ সালে ভারত ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে সনি্নবেশিত করেছে। ২০০৬ সালে নেপাল হিন্দু রাষ্ট্রের খোলস ছেড়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তাই বলা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ নীতির পথিকৃৎ।
একদল বুদ্ধিজীবী বলে চলছেন, ধর্মনিরপেক্ষতা নাকি জনপদের ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এটি যে তাদের মনগড়া ভাষণ তা সাংস্কৃতিক-নৃতাত্তি্বক ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল আমাদের শিল্প-সংস্কৃতিতেই নয়, অতীত রাজনীতিতেও তা লক্ষণীয়। সুদূর অতীতে রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক বিভাজনের বিপরীতে সমন্বয়ের চেষ্টা হয়েছে। সম্রাট অশোকের শাসন ব্যবস্থার উল্লেখ করা যায়। অশোক সর্বপ্রথম রাষ্ট্র থেকে ধর্মের সমদূরত্ব বজায় রেখেই দেশ শাসন করেছেন। বিরোধীদের সঙ্গে বিতর্ক ও মতবিনিময়ের প্রক্রিয়া চালু করেছিলেন। সেটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রেরই এক অনন্য উদাহরণ। এখানে মধ্যযুগের শাসক ধর্মে মুসলমান হয়েও দু\’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া ধর্মীয় শাসন প্রবর্তন করেননি। সম্রাট বাবর তার পুত্র হুমায়ুনকে হিন্দুস্তানের মাটি ও মানুষের প্রতি কর্তব্য পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সম্রাট আকবরের শাসনের মূলে ছিল ধর্মনিরপেক্ষ নীতি। তার শাসনকার্যের মূল নীতি ছিল \’রাহি আকল\’ অর্থাৎ যুক্তির পথ। কোনো ধর্মীয় বিধান নয়, যা যুক্তিগ্রাহ্য তা তিনি প্রয়োগ করেছেন। হিন্দু-মুসলিম সব ধর্মের মর্মবাণী তিনি ধারণ করেছিলেন। তার রাজসভায় একই সঙ্গে হিন্দু-মুসলিম সুপণ্ডিতদের ঠাঁই হয়েছিল। এটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বাংলার হুসেন শাহ হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সমন্বয়ের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তার সময়েই রামায়ণ-মহাভারতসহ বিভিন্ন গ্রন্থ বাংলায় অনূদিত হয়েছিল। তার অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ বোঝার জন্য একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়। কবি হরিদাশ ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তখন এ বিষয়ে হরিদাশের কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হলে তিনি রাজসভায় উপস্থিত হয়ে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেন। তা হলো_ \’শুন বাপ সবারই এক ঈশ্বর\\/নাম মাত্র ভেদ করে হিন্দুরে যবনে।/পরমার্থ এক কহে কোরানে পুরাণে।\’ তার এ ব্যাখ্যায় মুসলিম সভাসদরা সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সে সময় ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও স্বাধীনতার নীতি কার্যকর ছিল। তাই ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি হঠাৎ আরোপিত এবং এই জনপদের শাসনের ক্ষেত্রে বেমানান কিছু ভাববার কোনো অবকাশ নেই। বরং লক্ষণীয়, তা উপমহাদেশের শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে অধিক মাত্রায় সঙ্গতিপূর্ণ।
এখানে সুফিদের হাত ধরে ইসলাম এসেছে। তারা ধর্মের উদার মানবিক চেতনাই তুলে ধরেছেন। যা এ জনপদের মানুষকে উজ্জীবিত করেছে, শিকড় থেকে উৎপাটন করেনি। অমুসলিমদের সঙ্গে দেয়াল গড়েনি, বরং সম্প্রীতির জন্ম দিয়েছে। ইংরেজের ভেদনীতির মধ্য দিয়ে এখানে মানবিক ইসলামের স্থলে \’রাজনৈতিক ইসলাম\’কে উৎসাহিত করা হয়েছে। রাজনৈতিক ইসলামই ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাতিয়ার, যা প্রকৃত বিচারে ইসলামের মানবিক আদর্শসম্মত নয়।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ও তার ভাবাদর্শ দুয়েরই কবর রচিত হয়েছে। এখন নতুন করে পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভর করেছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করেছে। রগকাটা, গলাকাটা রাজনীতি করে চলেছে। তারা দেশি-বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনীতিকে কলুষিত করছে। আশার কথা, স্বাধীনতার ৪১ বছর পর ধর্মের নামে যারা একাত্তরে গণহত্যা-নারী ধর্ষণ করেছিল, সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দ্বার অবারিত রেখে এ অপশক্তিকে মোকাবেলা করা যাবে না। তাই বাংলাদেশকে একাত্তরের চেতনায় এগোতে হলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ রুদ্ধ করতে হবে।
সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতিভূ জামায়াত ক্যাডার বাহিনী গড়ে যে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে, তা প্রতিরোধ করা দরকার। তবে এটি চূড়ান্তভাবে মোকাবেলা করার জন্য চাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আদর্শবাদী রাজনীতি। সেটি করতে হলে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমুন্নত করার কোনো বিকল্প নেই। বলা আবশ্যক যে, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি রাষ্ট্রধর্ম বিধান রাখা হয়েছে, যা আত্মঘাতী।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, সরকার যেন মুখরক্ষার বিচার করতে চাইছে। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল প্রকারান্তরে জামায়াত রক্ষার নীতি গ্রহণ করেছে। এই আপসরফা নীতি নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ নীতি চর্চার মধ্য দিয়ে এসব অপতৎপরতার অবসান সম্ভব, অন্য কোনো পথে নয়। তাই যুদ্ধাপরাধী ব্যক্তি ও দলের বিচারের পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দ্বার যত শিগগির রুদ্ধ হবে, ততই মঙ্গল।
আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com