জানুয়ারি ৯, ২০১৩। রাজধানীর জাতীয় প্যারেড ময়দান। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লক্ষাধিক শিক্ষক সেখানে সমবেত হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ২৬ হাজার ২০০টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের ঘোষণা দেন। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়েন সমবেত শিক্ষক-শিক্ষিকারা। জাতীয়করণ হওয়ায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো বেতন-ভাতা পাবেন। স্বাধীনতার পর শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে। তারপর এই জাতীয়করণ প্রক্রিয়া থেমে যায়। কেবল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে হাজারখানেক স্কুল জাতীয়করণ করা হয়েছিল। এই প্রথম দেশের সব স্থায়ী-অস্থায়ীভাবে নিবন্ধিত, অনুমতিপ্রাপ্ত, অনুমতির জন্য সুপারিশকৃত এবং অনুমোদনের অপেক্ষমাণ সব বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হলো। এটি কেবল সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের জীবনেই নয়, জাতীয় ক্ষেত্রেও ইতিবাচক পদক্ষেপ। তৃণমূলে সবার জন্য শিক্ষা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এই উদ্যোগ।
যখন প্রধানমন্ত্রী জাতীয় প্যারেড ময়দানে এই ঘোষণা দিচ্ছিলেন, তখন প্রেস ক্লাবের সামনে কয়েক হাজার নন-এমপিও মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষক এমপিওভুক্তির দাবিতে অনশন করছিলেন। সেখান থেকে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দিকে অগ্রসর হওয়ার উদ্যোগ নিলে পুলিশ পিপার স্প্রে ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সংবাদপত্রে, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে আমরা একদিকে হাস্যোৎফুল্ল প্যারেড ময়দানের শিক্ষকদের ছবি, অন্যদিকে পুলিশের তাড়া খাওয়া শিক্ষকদের করুণ দৃশ্য দেখতে পাই। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। গত কয়েকদিন ধরে অনশনরত শিক্ষকরা প্রেস ক্লাব চত্বর, শহীদ মিনার, রমনা বটমূল_ যেখানেই বসছেন সেখান থেকে তাড়া খেয়ে ফিরছেন।
অনশন বা অবস্থান ধর্মঘট শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের একটি মাধ্যম। এটি করতে না দেওয়া গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। পুলিশ বলছে, তাদের ওইসব স্থানে অবস্থান করার অনুমতি নেই। সেটি হয়তো সত্য, কিন্তু তার চেয়ে সত্য জনগণ বা তাদের কোনো বিক্ষুব্ধ অংশ সর্বদাই আইনি ছক মেনে, অনুমতি নিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করে না। আর এ প্রতিবাদ তাদের সাংবিধানিক অধিকার। এই সত্য কি সংশ্লিষ্টরা বুঝতে অপারগ?
এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের প্রতি বর্তমান সরকারের এই আচরণ কোনো বিবেচনাতেই সমর্থনযোগ্য নয়। দেশের নাগরিক হিসেবে সরকারের এই আচরণে লজ্জা ও ঘৃণাবোধ করছি। ভাবতে কষ্ট লাগে, এভাবে শিক্ষকরা তাড়া খেয়ে ফিরছেন আর আমরা মুখ ঘুরিয়ে রেখেছি। দুয়েকজন বাম নেতা ও নাগরিক সমাজের কেউ কেউ সেখানে গিয়ে মুখরক্ষা করছেন। কিন্তু কার্যকরভাবে তাদের পাশে কেউ দাঁড়াচ্ছেন না। অতীতে এভাবে নাগরিক সমাজের কোনো অংশ নাজেহাল হলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র সংগঠনগুলো মিছিল নিয়ে ছুটে আসত, রাজনৈতিক দলের কর্মীরা সমাবেশে হাজির হতো। এখন আর এমনটা ঘটছে না, বৃহত্তর নাগরিক সমাজকে বিষয়টি তেমন নাড়া দেয় না।
আমরা কি একবারের জন্যও ভেবে দেখেছি, এই ৭ হাজার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যে দাবি করছেন তা কতটুকু যৌক্তিক? দেশে ৩৩ হাজার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, এর মধ্যে ২৬ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেগুলোতে শিক্ষকরা ১০০ ভাগ বেতন ও অন্যান্য ভাতা পাচ্ছেন। বাড়িভাড়া-মেডিকেল ভাতা নিয়ে তাদেরও অসন্তোষ রয়েছে, তবে সেটি পূরণে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু ৭ হাজার স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক বেতন-ভাতা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। ছাত্রবেতন থেকে আসা অর্থের ওপর নির্ভর করে নামমাত্র বেতনে চলতে হচ্ছে তাদের। অথচ নন-এমপিওভুক্ত স্কুলগুলো অন্য স্কুলগুলোর মতোই সরকারের সব শর্ত পূরণ করেছে এবং সরকারিভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। কিন্তু তাদের মান্থলি পে-অর্ডার (এমপিও) দেওয়া হচ্ছে না। এর অর্থ এই যে_ চাকরি দেওয়া হলো, কিন্তু মাসিক বেতনের আদেশ দেওয়া হলো না। এই আদেশ কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ৬ মাস বা এক বছরে মিলেছে, অথচ কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ২০ বছরেও মিলছে না। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেছে, যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে তাদের আনুকূল্যে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছে এবং পুরনো স্বীকৃতিপ্রাপ্ত স্কুলগুলো বরাবরই বঞ্চিত থেকেছে। এ ক্ষেত্রে কোনো সরকারই কোনো যুক্তির ধার ধারেনি, প্রভাব খাটিয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। যদি একই নিয়মে এমপিওভুক্ত করার প্রক্রিয়া থাকত, তবে ক্ষোভ এতটা তীব্র হতো না। শিক্ষা ব্যবস্থার এ দ্বৈততা বৈষম্য তৈরি করেছে যা সুশাসনেরও পরিপন্থী।
লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ২০ বছর অপেক্ষার পর এমপিওভুক্ত হলেও চাকরির কাল গণনা শুরু হয় এমপিওভুক্তির পর থেকে। ফলে এক বছরের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সঙ্গে ২০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষকদের কোনো পার্থক্য থাকছে না। একই সময় থেকে চাকরির মেয়াদকাল গণনা হচ্ছে, অর্থাৎ ২০ বছর পর এমপিওভুক্তির কারণে ওইসব শিক্ষকের জীবন থেকে ১৯টি বছর হারিয়ে যাচ্ছে। এমন অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। সর্বোপরি এমপিও পাওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে স্থানীয় এমপির কাছ থেকে ডিও লাভ এবং আমলাদের সন্তুষ্ট করার নানা কসরত।
এমন বাস্তবতায় একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সকল স্কুলকে এমপিওর আওতায় নিয়ে আসা সর্বাগ্রে বিবেচ্য। একবারে সেই দায়িত্ব গ্রহণ সরকারের জন্য কঠিন হতে পারে। তবে পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়িত হতে পারে, যেমনটি প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ (তিনটি ধাপে) বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেছেন, আপনারা ফিরে যান, আমি আপনাদের হয়ে লড়ছি। কিন্তু এ কথা তাদের ডেকে আলোচনার টেবিলে বলাটাই ছিল সঙ্গত। সরকার যদি এটি বিবেচনা করার ক্ষেত্রে আন্তরিক হয়, তবে সংগ্রামরত শিক্ষকদের কেন এভাবে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে? এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ১ থেকে ৪ অক্টোবর শিক্ষকরা ঢাকায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। তখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তারা বসার প্রস্তাব দিলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের জনৈক কর্মকর্তা তাদের আশ্বস্ত করেন। সংগ্রামরত শিক্ষকদের কাছে শুনেছি, প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে ২ ডিসেম্বর বৈঠকের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তা অনুষ্ঠিত হয়নি। এমন অনিশ্চয়তায়, ক্ষোভে, অপমানে দিনাজপুরের শিক্ষক নেতা দিলীপ কুমার আত্মহত্যা করেন। শিক্ষক নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রীর দফতরে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন। সর্বশেষ ১১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী সময় দেবেন বলা হয়। কিন্তু সেটিও পিছিয়ে যায়। এরপর তারা প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে বাধ্য হয়ে আবার ঢাকায় এসে অনশন শুরু করেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, সচিব কেউ তাদের সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন না। তারা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমানের কাছে গিয়েছিলেন। তিনি তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু তাতে সরকারের কতটুকু টনক নড়বে?
সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তারা স্থান বদল করে সমবেত হয়ে অনশন কর্মসূচি পালন করছেন। কিন্তু কোথাও স্থির হয়ে বসতে পারছেন না। পুলিশ-র্যাব পিপার স্প্রে দিয়ে অনশনরত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আরও অস্থির করে তুলছে। কিন্তু তারা রাজধানী ছাড়তে পারছেন না। বাড়িতে ফিরে অর্ধাহারে-অনাহারে ক্লিষ্ট পরিবার-পরিজনের কাছে কী আশার বাণী শোনাবেন? আমি যখন এ নিবন্ধটি লিখছি, তখন খবর পেলাম, ঢাকায় আগত পটুয়াখালীর শিক্ষক মোহাম্মদ সেকেন্দার আলী পিপার স্প্রেতে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন। দুর্ভোগ, অসুস্থতা ও হতাশায় ১৪ জানুয়ারি তিনি নিজ বাড়িতে মারা গেছেন।
আমরা কি জানি, কীভাবে রাজধানীতে তাদের দিন কাটছে? কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে, কেউ স্বল্প রেটের হোটেলে, ছাত্রাবাসে ছাত্রদের গলগ্রহ হয়ে থাকছেন, কেউ মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখান থেকে বিভিন্ন স্থানে একত্র হচ্ছেন, তাড়া খাচ্ছেন। এটি আমাদের কাছে অমর্যাদাকর ব্যাপার। এ অবস্থায় শিক্ষকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে সুরাহার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।
কারও অবোধগম্য নয় যে, সরকারের সীমাবদ্ধতা আছে। তবে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে রাষ্ট্রীয় সীমাবদ্ধতার মুখেও শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আজ জিডিপির মাত্র শতকরা ২.২৩ ভাগ শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় হচ্ছে, অথচ নেপালে শতকরা ৪.৭ ভাগ, ভারতও আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে, তাদের শতকরা ৩.৩ ভাগ। আমাদের বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষকতাকে বেতন-ভাতা আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে, যাতে মেধাবীরা শিক্ষকতার পেশা গ্রহণে আগ্রহী হয়। বেতন-ভাতা না বাড়িয়ে শিক্ষার মান বাড়ানো সম্ভব নয়। শিক্ষা খাতে বরাদ্দকে বিনিয়োগ হিসেবে ভাবতে হবে। মনে রাখতে হবে, দক্ষ মানবশক্তি গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে অধিকতর বিনিয়োগের বিকল্প নেই।