জনগণ উদ্বিগ্ন_ কী ঘটছে, কী ঘটতে যাচ্ছে? কোথায় চলেছে দেশ? গত ৯ ডিসেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অবরোধকালে চারটি প্রাণ অকালে ঝরে পড়েছে। এর মধ্যে বিশ্বজিৎ দাস নামের এক নিরপরাধ যুবককে বিএনপির কর্মী সন্দেহে কুপিয়ে-পিটিয়ে হত্যা করেছে সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ কর্মীরা। যদিও আওয়ামী লীগ বলছে_ ওরা ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী। গণমাধ্যম ছাত্রলীগের সঙ্গে খুনিদের সংশ্লিষ্টতার দালিলিক প্রমাণও তুলে ধরছে। তারপরও তারা সত্য স্বীকারে নারাজ। অন্যদিকে ১১ ও ১৩ ডিসেম্বরের হরতালে ১৮ দলও জ্বালাও-পোড়াও-ভাংচুর করেছে দেদার।
সরকার ও বিরোধী দল অনড় অবস্থানে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে চাইছে না। ফলে সংঘাত দুর্নিবার হয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতিতে জনমনে আতঙ্ক বাড়ছে। তাতে সরকার ও বিরোধী দলের কোনো উদ্বেগ নেই। নেই আলোচনার কার্যকর উদ্যোগও। উপরন্তু বিরোধী দলের মহাসচিবকে গ্রেফতারের মাধ্যমে সরকার উত্তাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। বিএনপির ব্যানারে জামায়াত-শিবির মরিয়া হয়ে উঠেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর জন্য। এখন ইস্যু দুটি। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার_ এ দাবিতে বিরোধী দল আন্দোলন করছে; দুই. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার_ এ ব্যাপারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী জামায়াতে ইসলামী ছাড়া কেউ বিরোধিতা করছে না। বরং দ্রুত বিচার অনুষ্ঠানের জন্য জোর দাবি রয়েছে।
সবারই জানা যে, বিএনপি-জামায়াতসহ ১৮ দল অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে অনড়। ক্ষমতাসীন জোট বলছে, পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে যে বিধান প্রণীত হয়েছে, সে অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ব্যাপারে মহাজোটের শরিক জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি ইতিপূর্বে ভিন্নমত পোষণ করলেও এখন কোনো উচ্চবাচ্য করছে না। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, মহাজোটের শরিকদের কথা নয়, আওয়ামী লীগ কী ভাবছে_ সেটিই বড় কথা। তার চেয়ে বড় কথা, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা কী ভাবছেন_ সেটিই আওয়ামী লীগের শেষ কথা। অন্যদিকে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার কথাই ১৮ দলের সিদ্ধান্ত। কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে, এ দুই নেত্রী একজন আরেকজনের ছায়াও মাড়াতে চান না। দৈবাৎ সাক্ষাৎ হলে দু\’জন দু\’মুখী হন।
এ পরিণতিতে বিবদমান ইস্যুতে রাজনৈতিক সমাধান কতটুকু সম্ভব, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। তারপরও বলতে হয়, সংলাপ, সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। আর সে ক্ষেত্রে সরকারের দায় সর্বদাই সর্বাধিক। অস্বীকার করার জো নেই যে, সংকটের বীজ বুনেছে সরকারই। মীমাংসিত বিষয়টিকে করেছে অমীমাংসিত।
সবার কাছে গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে ছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ সে সময়ের বিরোধী সংগঠনগুলোর দাবির মুখে তা সনি্নবেশিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী, এটি তাদের ব্রেইন চাইল্ড। কিন্তু বলা নেই কওয়া নেই; বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা নেই_ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তা বাতিল করা হলো। তখন থেকেই সংকটের সূত্রপাত। যদিও আওয়ামী লীগ বলছে, ত্রয়োদশ সংশোধনীর ওপর আদালতের রায়ের কারণে এটি করতে হয়েছে। এ কথা কতটুকু গ্রহণযোগ্য? বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও অন্যদের দেওয়া রায়েও ডকট্রিন অব নেসেসিটির উল্লেখ করে দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা যেতে পারে বলে অভিমত দেওয়া হয়েছে। অতএব, বিষয়টি গড়িয়েছে সংসদের ওপর। মহাজোট তার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করেছে।
এ কথা সত্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটিতে কিছু সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। সাবেক প্রধান বিচারপতিকে সরকারপ্রধান করার বিধান রাখার কারণে বিচার ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়সীমা সুনির্দিষ্ট করার বিষয়টি অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। এ জাতীয় সংশোধনী নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কও ছিল না। বরং ঐকমত্য পরিলক্ষিত হয়েছিল। অথচ মহাজোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে বিধানটি বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের রাস্তা তৈরি করল।
প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন করার জন্যই কি এটি করা হয়েছে? সে ক্ষেত্রে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল করে নির্বাচনে যাওয়ার কৌশলের কথা শোনা যায়। এরশাদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, তিনি বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এই গৃহপালিত বিরোধী দল দিয়ে সৃষ্ট সংকট মোকাবেলা করা কি আদৌ সম্ভব?
আমাদের মনে রাখা দরকার, আসন সংখ্যায় মহাজোট যতখানি সংখ্যাগরিষ্ঠ, ভোটের সংখ্যায় তা নয়। দুটি দলেরই কাছাকাছি সংখ্যক সমর্থক রয়েছে। এ কারণে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বিএনপির ১৯৯৬-এর মধ্য ফেব্রুয়ারির নির্বাচন যেমন গ্রহণযোগ্য হয়নি, তেমন নির্বাচন আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার করলেও তা গ্রহণযোগ্য হবে না। সরকার এ সত্য অনুধাবন করলেই কেবল সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, বিরোধী দলের ভূমিকা হতাশাব্যঞ্জক। দলটি সংবিধান বর্ণিত দায়িত্ব পালন করছে না। লাগাতার সংসদ বর্জন করে চলেছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপি নেতারা অতীতে আওয়ামী লীগের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। অন্যের ভুল দৃষ্টান্ত তাদের ভুলকে অনুমোদন করে না। এটিকে কেউ কেউ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখতে চান, কিন্তু এটি ভ্রান্ত কৌশল। তা সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনকে ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ১৮ দলের এই আন্দোলন কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন, না এই আন্দোলনের ভেতরে অন্য স্বার্থ হাসিলের খেলা শুরু হয়েছে? আমরা ১৮ দলের সমাবেশ-কর্মসূচিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির চেয়ে জোরেশোরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ; গোলাম আযম, নিজামী, সাঈদী, মুজাহিদের মুক্তির দাবি শুনছি। গত ২৮ নভেম্বরের সমাবেশে জোটনেত্রী খালেদা জিয়া কোনো নেতার প্রতিকৃতি আনতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তা উপেক্ষা করে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা গোলাম আযম, নিজামী প্রমুখ যুদ্ধাপরাধীর প্রতিকৃতি ও মুক্তির দাবিতে লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে হাজির হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের ছবি চিত্রিত বেলুন আকাশে উড়িয়ে সবার দৃষ্টি কেড়েছে জামায়াত-শিবির কর্মীরা।
একদিকে বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা বলছে, অন্যদিকে তাদের সমাবেশে থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবি তোলা হচ্ছে। এটি কি দলটির স্ববিরোধিতা নয়? শুধু তাই নয়; যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবিতে জামায়াতে ইসলামীর হরতালকে নৈতিক সমর্থন দিয়েছিল বিএনপি। এর এক হাস্যকর ব্যাখ্যা দিয়েছে দলটি। সেটি হচ্ছে, \’আমরা সমাবেশ করার দাবির প্রতি সমর্থন দিয়েছি; যুদ্ধাপরাধীর বিচার বন্ধ বা তাদের মুক্তির দাবির প্রতি সমর্থন দিইনি।\’ জামায়াতের ৪ ডিসেম্বরের হরতালের দাবিই ছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ ও মুক্তি_ তখন সেই কর্মসূচির প্রতি সমর্থন দেওয়া প্রকারান্তরে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সমর্থনেরই শামিল।
বিএনপির এই কৌশল আত্মঘাতী। বিএনপি হয়তো মনে করেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায়ের আন্দোলনে জামায়াতের জঙ্গি কর্মীদের কাজে লাগিয়ে আন্দোলন বেগবান করবে। কিন্তু সেই আন্দোলন কি সঠিক খাতে প্রবাহিত হবে? এ ক্ষেত্রে জামায়াতকে ব্যবহার করার কৌশল বুমেরাং হতে পারে_ তা কি বিএনপির নীতিনির্ধারকরা ভেবে দেখেছেন?
উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আয়োজন কোনো দলীয় ব্যাপার নয়। এটি জাতীয় দাবি। একাত্তরের বিজয়ী জাতি স্বাধীনতার উষালগ্নেই যুদ্ধাপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে এই কলঙ্ক মোচন চেয়েছে। কিন্তু প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। যেটি ৪১ বছরে সব সরকারেরই দুর্বলতা-ব্যর্থতা। স্বাধীনতা-উত্তর সরকারের সাধারণ ক্ষমায় একাত্তরের ঘাতকদের অনেকেই পিঠ বাঁচিয়েছে, \’৭৫-এর পর সুনির্দিষ্ট অভিযোগে দায়ীরাও অব্যাহতি পেয়েছে এবং সামরিক সরকারের ঘাড়ে চড়ে রাজনীতির মাঠে নেমেছে। \’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পরও আমরা ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দল দুটির জামায়াত-মৌলবাদী তোষণনীতি প্রত্যক্ষ করেছি, হীন রাজনৈতিক স্বার্থে জামায়াতকে কাছে পাওয়ার জন্য টানাটানি দেখেছি এবং নিজামী-মুজাহিদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়তেও দেখেছি। এসবই ভুল ও সুবিধাবাদী রাজনীতির পরিণতি। এ দায় কার, কতটুকু_ সে আলোচনা আজ থাক। সব দলের দাবি যখন একাত্তরের কালিমা মুছে ফেলার জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, তখন বিএনপির জামায়াত প্রশ্রয় নীতি কি আদৌ সমর্থনযোগ্য? কারও বিস্মৃত হওয়া উচিত নয় যে, জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতারাই কেবল যুদ্ধাপরাধী নয়, দলটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে গণহত্যাসহ অপকর্ম করেছে। বিলম্বে হলেও সেই দলটির সংশ্রব ত্যাগ করা সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলের কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে বিএনপির যুক্তি হচ্ছে, আওয়ামী লীগ স্বৈরাচারের হাত ধরেছে। সেটি অপরাধ না হলে জামায়াতের হাত ধরা কেন অপরাধ হবে? আসলে জাতীয় মর্যাদা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে উভয় দলেরই সুবিধাবাদী রাজনীতি পরিহার করতে হবে। বিএনপিতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যারা একাত্তরের গৌরবগাথা নিয়ে গর্ব করেন। সেই দলটি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করবে এবং গণতন্ত্রের দাবিদার আওয়ামী লীগও স্বৈরাচারীর সঙ্গ ত্যাগ করবে_ জনগণ সেটিই প্রত্যাশা করে।
দেশের সামগ্রিক স্বার্থে নির্বাচন পদ্ধতি কী হবে, সেটি যেমনি সংলাপ-সমঝোতার মধ্য দিয়ে নিরূপণ করা প্রয়োজন, তেমনি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রশ্নে সব দলের আন্তরিক সমর্থন প্রয়োজন। গণতন্ত্রের যাত্রা নিষ্কণ্টক করতে এর কোনো বিকল্প নেই।