চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও উত্তাপের মধ্যে ঘুরেফিরে আসছে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রসঙ্গ। ড. ইউনূস কোনো রাজনীতিক নন, তবু ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক হয়ে উঠেছে যেন রাজনৈতিক ইস্যু। এ নিয়ে সরকার-বিরোধী দল ও সমাজের নানা মহলে শুরু হয়েছে নানামুখী বিতর্ক।
গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের আর দশটি ব্যাংকের মতো একটি ব্যাংক হলেও এর মালিক ৮০ লাখ প্রান্তিক নারী। আজ থেকে ৩৮ বছর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জোবরা গ্রামে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গরিব জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু করেন, সেখান থেকে যাত্রা শুরু গ্রামীণ ব্যাংকের। এখন দেশব্যাপী প্রসারিত এর কার্যক্রম। ১৯৮৩ সালে একটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে গ্রামীণ ব্যাংক গঠন করা হয়। ক্ষুদ্রঋণের এই মডেল দেশের ঠিকানা ছাড়িয়ে এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনুসৃত হচ্ছে। যার স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি তার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠানোর ঘোষণা দেন। তখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার ভাষণ শুনেছি। কিন্তু যারা কেবল ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসনের তত্ত্বকে সঠিক ভাবতে পারে না_ আমি তাদের সঙ্গেই একমত পোষণ করি। হিসাব মেলে না কীভাবে অবাধ পুঁজিবাদী আধিপত্য, অব্যাহত শোষণ-বঞ্চনা, ভাত, কাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার অধিকারহীনতা সত্ত্বেও কেবল ক্ষুদ্রঋণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে পারে? ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কারও কারও ভাগ্যবদলের সফল উদাহরণ আছে, সেই সঙ্গে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ার উদাহরণও ঢের। ক্ষুদ্রঋণের সমালোচনা করে লিখেছি, সভা-সেমিনারে বক্তৃতা করেছি। এমনকি বছরখানেক আগে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে যখন ৬০ বছরের অধিক বয়স হওয়ায় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তখন ইটিভিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক দুই উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন খান ও হোসেন জিল্লুর রহমানের সঙ্গে টক শোতে সরকারের সিদ্ধান্ত সমর্থন করে বলেছিলাম, সব ব্যাংকের এমডির বয়স যদি ৬০ বছর নির্ধারিত থাকে, তবে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষেত্রে কেন ব্যক্তিক্রম হবে?
প্রসঙ্গক্রমে, ১/১১-এর পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ারও সমালোচনা করেছি। এখনও করি। এটি কারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, আমি ড. ইউনূসের সমর্থক বা অনুগত কেউ নই। ভিন্ন মত ও পথের একজন হয়েও আমার জিজ্ঞাসা_ সরকার ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি যে আচরণ করছে তা কতটুকু যৌক্তিক?
দেশের সব ব্যাংকের এমডি নিয়োগের ক্ষমতা পরিচালনা পর্ষদের রয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষেত্রে কেন এর ব্যতিক্রম হবে? ১৯৮৩ সালের গ্রামীণ ব্যাংকের অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরিচালনা পরিষদের সে এখতিয়ার সংরক্ষিত। সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ সভায় তা পরিবর্তন করে চেয়ারম্যানকে একটি বাছাই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর ফলে কী দাঁড়াবে? সরকারের নিয়োজিত চেয়ারম্যান তার ইচ্ছামতো বাছাই কমিটি করে পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ দেবেন। চেয়ারম্যান রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত হলে এমডিও হবেন রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত। কার্যত ব্যাংকটি সরকারের ইচ্ছার দাসে পরিণত হবে।
লক্ষণীয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে এমডির পদ থেকে অপসারণের পর বর্তমানের বিধি অনুযায়ী এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে পরিচালনা পরিষদের মতামতের কারণে সরকারের পছন্দমতো ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। কারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, সে কারণে আজ বিধির পরিবর্তন। এটি কি সুশাসন ও গণতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচায়ক? বিধির পরিবর্তন করার মধ্য দিয়ে যা করা হচ্ছে তা নিশ্চিতভাবেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত করে না।
শুধু তা-ই নয়, মন্ত্রিসভার বৈঠকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্ধারিত বয়সের অতিরিক্ত সময়ে দায়িত্ব পালনকালে কী পরিমাণ অর্থ নিয়েছেন এবং তা বৈধ ছিল কি-না, সেটি খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। এমডি থাকাকালে ওয়েজআর্নার হিসেবে কত টাকা বিদেশ থেকে এনেছেন এবং তিনি তা আনতে পারেন কি-না, এনে থাকলে কী পরিমাণ কর অব্যাহতি নিয়েছেন, সে বিষয়ে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এগুলো প্রশাসনিক নিয়মে সংশ্লিষ্টরা খতিয়ে দেখতেই পারেন। তাতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু যখন মন্ত্রিপরিষদ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এমন সিদ্ধান্ত দেয়, তখন সেটি স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বলে বিবেচিত হয় না। এতে প্রতিভাত হয় যে, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে এক ধরনের ক্ষোভ ও আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। কিছুদিন ধরে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে এমন ক্ষোভের প্রকাশ দেখছি। ড. ইউনূসকে রক্তচোষা, দেশের শত্রু আখ্যায়িত করা হচ্ছে, অথচ এর আগে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম নিয়ে তারা গর্ব করেছেন। ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াশিংটনে বিশ্ব ক্ষুদ্রঋণ সম্মেলনে কো-চেয়ারের দায়িত্ব পালন করেন এবং বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকা নিয়ে গর্ব করেন। তখনও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম নিয়ে বিতর্ক ছিল, কিন্তু ক্ষুদ্রঋণের পক্ষে সরকারের মন্ত্রী-কর্মকর্তারা জোরালো বক্তব্য রেখে আসছেন। আজ হঠাৎ করে ড. ইউনূসবিরোধী হওয়ার মাধ্যমে কি সরকার গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণ বিরোধী হয়ে পড়ল? গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হলেও দেশে কর্মরত হাজারো ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিতে যুক্ত এনজিওগুলোর ব্যাপারে সরকারের কোনো ক্ষোভ নেই। গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ে বেশি সুদের বিনিময়ে ঋণ কার্যক্রম পরিচালিত হলেও সেগুলো যথাযথভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে না। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ড. ইউনূসের সঙ্গে সরকারের বৈরী অবস্থান কোনো নীতিগত বিষয় নয়। তবে কি ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যেই করা হচ্ছে?
গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক ড. ইউনূস নন, কিন্তু এটির প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে তার উদ্ভাবনী প্রতিভা কাজ করেছে। সেই ব্যক্তিকে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। যখন তাকে এমডি থেকে অপসারণ করা হয়, তখনও মনে হয়নি যে, তার সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা থাকবে না। চেয়ারম্যান হিসেবে তাকে রাখার সুযোগ ছিল, এখনও রয়েছে। কিন্তু সে পথে গেল না সরকার। প্রশ্ন হলো, তাকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বিচ্ছিন্ন করে সরকারের কী লাভ? বরং গ্রামীণ ব্যাংক কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার স্বার্থেই ড. ইউনূসকে ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাখা উচিত।
ড. ইউনূসের প্রতি সরকারের এই ক্ষোভের পেছনে অনেক কথা শোনা যায়। তার একটি হচ্ছে, দেশে গণতন্ত্র বিধ্বংসী প্রক্রিয়ার সঙ্গে তার যোগসাজশ রয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতুর ঋণ আটকিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ড. ইউনূসের হাত রয়েছে। এসব অভিযোগ গুরুতর। জানি না_ এ ব্যাপারে সরকারের কাছে কোনো তথ্য-প্রমাণ আছে কিনা! তথ্য-প্রমাণ না দিয়ে এ ধরনের অভিযোগ আনবেন, তা সমর্থন করা যায় না।
কেউ বলতে পারেন, এটি সরকারের এখতিয়ার, জনগণ তাদের ভোট দিয়েছে, তারা তাদের মতো করে দেশ চালাবেন। ইচ্ছামতো ব্যাংকসহ সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান পরিচালনার বিধান পরিবর্তন করবেন। কিন্তু পরিবর্তন হতে হবে গণতন্ত্রসম্মত ও যুক্তিগ্রাহ্য। জনমত ও যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
সরকার মতাদর্শ নির্বিশেষে সবার অধিকার রক্ষা করবে_ সেটি প্রত্যাশিত। কেউ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিবেচিত হলে তাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা উচিত, কিন্তু তার অধিকার কেড়ে নিয়ে তা করা যৌক্তিক নয়। এমন আক্রোশ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা দরকার যে, সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী সবাইকে শপথ নিতে হয়েছে_ \’… অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।\’ কারও প্রতি আক্রোশ, ক্রোধবশত তাকে এক হাত দেখিয়ে দেওয়া সেই শপথের বরখেলাপ, যা জনপ্রতিনিধিত্বশীল কোনো সরকারের কাছ থেকে আশা করা যায় না।
তাই সঙ্গতভাবে আশা করব, গ্রামীণ ব্যাংক যেন এর বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখে চলতে পারে, সেই সুযোগ নিশ্চিত করা হোক। কোনো অজুহাতেই জটিলতা সৃষ্টি করে ব্যাংকটির স্বাধীন বিকাশে বাধা হওয়া সরকারের কাজ নয়।
সরকারকে মনে রাখতে হবে, গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক ৮০ লাখ প্রান্তিক মানুষ। ড. ইউনূসের ওপর আক্রোশের তীর যদি তাদের স্বার্থকে বিদীর্ণ করে, তবে তা হবে দারিদ্র্যপীড়িতদের অধিকার হরণেরই শামিল।
আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com