একুশে ফেব্রুয়ারি সকালের সংবাদপত্রে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি খবরের পাশে লাল হরফে বড় করে ছাপা আরেকটি খবর_ ‘রক্তাক্ত বাঘাইছড়ি’। বাঙালি বনাম পাহাড়ি সংঘর্ষের এ খবরটি মুহূর্তেই যেন শহীদ দিবসের স্মৃতিকে ম্লান করে দিল। ওইদিনেরই পত্রিকার আরেক খবর_ জাতীয় সংসদের স্পিকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষার স্বীকৃতির কথা বলেছেন।অন্যদিকে বাঘাইছড়িতে তখন পাহাড়ি নরনারী শোকে-ভয়ে-আতঙ্কে দিশেহারা। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে যে, ভাষাশহীদের স্মৃতিবিজড়িত মাসে দুর্বৃত্তের হামলায় রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে ৫টি তাজা প্রাণ ঝরে পড়ল।পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি যা ঘটেছে, তা বেদনাদায়ক। খবরে প্রকাশ, পাহাড়িদের প্রায় ৩৫৭টি বাড়ি পুড়েছে। ১৫০০ পাহাড়ি গৃহছাড়া। ভয়ে-আতঙ্কে গভীর বনে চলে গেছে ২ হাজারের বেশি পাহাড়ি নরনারী ও শিশু। অন্যদিকে ১০০ বাঙালির বাড়ি পুড়েছে। গৃহহারা চার শতাধিক।নানাসূত্রে প্রকাশ, বাঘাইছড়িতে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে যে উত্তেজনা চলছিল তা আগেই সরকারকে অবহিত করা হয়েছিল। তা-ই যদি হয়, তবে পূর্বাহ্নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হলো না কেন? কার্যকর পদক্ষেপ নিলে হয়তো সেদিন বাঘাইছড়ি রক্তাক্ত হতো না। গৃহহারা হতো না এত পরিবার। প্রশাসনের ভূমিকা এখানে প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ঘটনা থেমে ছিল না সেখানেও, কারফিউ দিয়ে পাহাড়িদের গণগ্রেফতারের অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় প্রশাসনের প্রতি অবিশ্বাস জন্মেছে পাহাড়িদের, বেড়েছে দূরত্ব।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বড় সমস্যা হচ্ছে প্রশাসন তিনভাবে বিভক্ত। এক. বেসামরিক প্রশাসন; দুই. সামরিক প্রশাসন; তিন. পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। এই তিন অংশের মধ্যে যে কোনো সমন্বয় নেই, তা নানা সময়ে তাদের বক্তৃতা-বিবৃতি পড়লেই বোঝা যায়। আর এই তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুর্বলতর স্থানে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। অথচ আঞ্চলিক পরিষদকে ক্ষমতায়ন করাই হচ্ছে ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত শান্তিচুক্তির মর্মবাণী। কিন্তু এখনও তা বাস্তবায়ন হয়নি। পাশাপাশি, দীর্ঘদিনের দাবি সত্ত্বেও বেসামরিক প্রশাসনের ভূমিকাও গৌণই রয়ে গেছে।
শান্তিচুক্তি প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান ছিল নেতিবাচক। তাই বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে শান্তিচুক্তি শিকেয় তুলে রাখা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলেই শান্তিচুক্তি হয়েছে। পাহাড়ে শান্তি স্থাপনের পথে তারাই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশকে এগিয়ে দিয়েছিল। বর্তমান সরকারের আন্তরিকতা নিশ্চয়ই আছে চুক্তি বিষয়ে। কিন্তু বর্তমানের পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, মহাজোট ধীর পায়ে চলছে। শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দলের অবস্থান একটি বাধা। তবে সবচেয়ে বড় বাধা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন এসে যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক পরিষদশাসিত ব্যবস্থার প্রতি কতটুকু শ্রদ্ধাশীল? দীর্ঘদিন ধরে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পার্বত্যবাসীকে বশে আনার চেষ্টা চলেছিল। কিন্তু দীর্ঘ পথপরিক্রমায় সব পক্ষই আজ স্বীকার করে নিয়েছেন যে, বলপ্রয়োগ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সমাধান নেই। কিন্তু অনেক প্রশাসনিক কর্মকর্তাই এ সত্য উপলব্ধি করতে পারেননি। তারা যেন বলপ্রয়োগের নীতি আঁকড়ে ধরে আছেন। এটি একটি বড় সমস্যা। এ সমস্যার গভীরে রয়েছে একটি মনস্তাত্তি্বক ব্যাপার। আমি বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, তারা নিজেদের শাসক এবং পাহাড়িদের শাসিত মনে করেন। এমন মনোভাব থেকে মুক্ত নন কোনো কোনো নীতিনির্ধারকও। বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের একটি সংকীর্ণতার বোধ তাদের মজ্জাগত। সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশ বাঙালির রাষ্ট্র। বাঙালি হচ্ছে জাতি, আর সব ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী হচ্ছে উপজাতি। পাকিস্তান আমলে বলা হয়েছিল, পাকিস্তান মুসলমানের রাষ্ট্র। আর অমুসলমানরা এখানে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। তাদের পদাঙ্ক অনুসারীরা বাংলাদেশকে এখন বাঙালি মুসলমানের রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম তাদের কূটযুুক্তির বর্ম।
বাংলাদেশ কেবল বাঙালির রাষ্ট্র নয়_ এখানে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল সবাই সমমর্যাদার নাগরিক। একইভাবে বাংলাদেশ কেবল মুসলমানের রাষ্ট্র নয়_ এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষের রয়েছে সমান মর্যাদা ও অধিকার। এই উপলব্ধি বাংলাদেশের সংহতি ও সুশাসনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের এই বিশ্বাস ধারণ করতে হবে যে, পাহাড়িদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সেই বোধের বিকাশ ভিন্ন পার্বত্য সমস্যা সমাধানের কোনো পথ নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কিছু বৈষয়িক স্বার্থও। পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক ভূমি স্বনামে-বেনামে লিজ নিয়েছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা; বোধগম্য কারণেই তারা শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন ও আঞ্চলিক পরিষদের ক্ষমতায়ন চান না। তারা চান অশান্ত পরিবেশে স্বীয় স্বার্থ হাসিলের পথ খোলা রাখতে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সমতল থেকে বিপুলসংখ্যক ছিন্নমূল নর-নারীকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করানো হয়েছিল, যারা জনসংহতির আন্দোলন মোকাবেলায় লাঠিয়াল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। বলাবাহুল্য, এই বাঙালি পুনর্বাসন নীতির কারণেই পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। ১৯-২০ ফেব্রুয়ারির প্রতিপক্ষ এই সেটেলার বাঙালি। সেটেলার ও পাহাড়িদের মধ্যে ভূমি নিয়ে বিরোধের পেছনেও রয়েছে সরকারের ভ্রান্তনীতি।
আমরা জানি, পাহাড়িদের ভূমি ব্যবস্থাপনা সমতলের মতো নয়, জন্মসূত্রে তারা পাহাড়ি ভূমি ভোগদখল করছে। সেই জমির ওপর জবরদস্তিমূলক বসতি স্থাপন তারা মেনে নিতে পারছে না। পক্ষান্তরে, পুনর্বাসিত বাঙালিরা টিকে থাকার জন্য মরিয়া। এ পরিস্থিতিই সংঘর্ষের মূল কারণ। এখন সরকারের কী করণীয়? তারা কি এই রক্তক্ষয়ী খেলা দেখবে, না কোনো যৌক্তিক পদক্ষেপ নেবে?
সেটেলারদের সমস্যাও মানবিকভাবে দেখা প্রয়োজন। পাহাড়িদের ভোগদখলকৃত জমি থেকে তাদের সরিয়ে এনে বিকল্প পুনর্বাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে আমলা-ব্যবসায়ীদের দখলকৃত জমির লিজ বাতিল করে সেখানে সেটেলারদের পুনর্বাসনের কথা ভাবা যেতে পারে। পাহাড়ের পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিল্প-কারখানা স্থাপন করে সেখানে সেটেলারদের পুনর্বাসন করা সম্ভব।
এটি স্মরণ রাখতে হবে, ভূমি সমস্যাই পার্বত্য সমস্যার মূলে। ব্রিটিশ শাসকরা যখন ব্যাপক ভূমি খাস ঘোষণা করেছিল, তখন পাহাড়িরা তা মেনে নিতে পারেনি। তারা ভুলতে পারেনি পাকিস্তান আমলে নেওয়া কাপ্তাই প্রকল্পের কারণে হাজার হাজার একর জমি হারানোর মর্মবেদনা। তখন ব্যাপক নর-নারী উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়, তবে সবচেয়ে বেশি নর-নারী উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে আশি ও নব্বই দশকের সংঘাতময় পরিবেশে। যারা সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিল, যারা শান্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাদের বিষয়টি আমরা জানি। কিন্তু তার চেয়ে কয়েকগুণ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে গৃহহারা-জমিহারা হয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে_ তাদের খবর কেউ রাখে না। লোগাং, নানিয়ারচর প্রভৃতি ঘটনায় কত নর-নারী উদ্বাস্তু হয়েছে, সে হিসাব কারও জানা নেই। গত ১৯-২০ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় উদ্বাস্তুদের মিছিলে নাম লিখিয়েছে আরও কয়েকশ’। এর ইতি টানা দরকার। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে তাদের নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তুলেই এই সংঘর্ষের অন্ত ঘটানো সম্ভব।
উদ্বাস্তু পাহাড়ি এবং সমতল থেকে যাওয়া ছিন্নমূল বাঙালিদের পুনর্বাসনের জন্য সুবৃহৎ পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ। তবে তা আঞ্চলিক পরিষদ ও বেসামরিক প্রশাসনের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করতে হবে। শান্তিচুক্তির শর্ত অনুযায়ী সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। একটি ভ্রান্ত ধারণা আছে, যা কোনো কোনো মহল, বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াত প্রচারও করছে_ তা হলো, সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করায় এ ঘটনা ঘটেছে, অতএব নতুন করে সেনাক্যাম্প স্থাপন করতে হবে। এ ব্যাপারে কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনও। তিনিও বলেছেন, প্রয়োজনে আবার সেনাক্যাম্প স্থাপন করা হবে।
কিন্তু আমার প্রশ্ন, বাঘাইছড়ির ঘটনাস্থলের কাছেই ছিল সেনাক্যাম্প। এখানে স্পষ্ট যে, পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে সেনাউপস্থিতি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। বরং সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে। এ সত্য উপলব্ধি করে বিএনপি সরকারের সময়েও কয়েকটি সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছিল। সরকার সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে শান্তিকামী মানুষের সমর্থন পেয়েছে। তাই কালবিলম্ব না করে, ক্যাম্প প্রত্যাহার ও বেসামরিক প্রশাসনের ভূমিকা জোরদার করতে হবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে নির্বাচিত ও স্থানীয় আঞ্চলিক পরিষদকেই ক্ষমতায়ন করতে হবে।
বলপ্রয়োগ নয়, সৌহার্দ্যের হাত বাড়িয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে দেশের রাজনীতি ও উন্নয়নের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এক্ষেত্রে পাহাড়ি নেতৃত্বের কাছেও ধৈর্যশীল ও বাস্তবসম্মত ভূমিকা প্রত্যাশিত।
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla@yahoo.com